Search

ছোটগল্পঃ বাসরগীতি

  • Share this:

বউ নিয়ে ফেরার পথে ছোটবোন শাহানা আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,

"এই দাদা, ভাবী কিন্তু কবুল বলে নাই।"

শাহানার কথা শুনে পেটের ভেতর কলেরা বসে গেল। খুবই উদ্বিগ্ন অথচ চাপা স্বরে জানতে চাইলাম,

"পাগল নাকি? কী বলিস এইসব?"

"আল্লাহর কসম, আমি পাশেই ছিলাম। ভাবী খুব কাঁদতেছিল। কবুল বলার জন্যে সবাই চাপাচাপি করতেছিল। পাশ থেকে তখন অন্য একজন নিচু স্বরে কবুল বলে..."

"নাউজুবিল্লাহ!" বলে কেঁপে উঠলাম। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে দ্বিতীয় কোনো আওয়াজ বা কৈফিয়ত চাওয়ার সুযোগ পেলাম না। শাহানার দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙিয়ে বললাম,"খবরদার, এইসব উল্টাপাল্টা কথা আর যেন না শুনি!"

শাহানা ঠোঁট মুচড়ে বলল,"তোর বউ, তুই বোঝ। আমার এত ঠেকছে, হুহ!"

সে আমার পাশের সীটে বসা। একটুখানি দূরে সরে গিয়ে জানালায় চোখ পাতল। গাড়ি চলছে উল্কার বেগে। বাড়ি ফিরছি, বউ নিয়ে। নতুন বিয়ে করা বউ। বউ আমার পাশেই বসা।

সম্পূর্ণ অচেনা একটা মেয়ে, লালশাড়িতে, বহুদামী অলঙ্কারে আচ্ছাদিত ওর দেহ। শাড়ির আঁচলটা মাথার উপর টেনে রাখায় মুখ দেখতে পারছি না। উপরন্তু সেও বিপরীত দিকের জানালার দিকে চোখ পেতে রেখেছে। এই মেয়ে কবুল বলে নাই? অথচ আজ রাতে ওর সাথেই বাসর হবে আমার?

নাউজুবিল্লাহ! কী করব ভেবে পাচ্ছি না!

পেটের ভেতর গুড়গুড় করছিল। মাথায় নিকোটিনের নেশা চেপে গেলো। শাহানা এইটা কী বলল আমাকে? পাশ থেকে কোন মেয়ে কবুল বলছে? কারে আমি ঘরে নিয়ে যাচ্ছি?

"লা ইলাহা ইল্লা আনতা..."

বজ্রপাতের সময় বাইরে থাকলে এই দোয়া পাঠ করি। বজ্রপাত শুরু হয়েছে ভেতরে। মেয়েটার দিকে আবারও তাকালাম। ইডেনের ছাত্রী। সদ্য অর্নাস শেষ করেছে। নিচের তলার আন্টি আমার আম্মার সাথে আঁতাত করে এই বিয়ের ঘটকালি করেছে। আন্টি এবং আম্মারা পেছনের গাড়িতে। গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, "মেয়ে কবুল বলে নাই কেন? তখন তো খুব জোর গলায় বলেছিলেন, শান্তা খুব শান্ত মেয়ে। একেবারে লক্ষ্মী মেয়ে। হিজাব ছাড়া ফেক্সিলোডের দোকানেও যায় না..."

ফেক্সিলোডওয়ালা আন্টির উপর রাগ বাড়ছে। নিজের উপরেও রাগ বাড়ছে। ঘরোয়াভাবে মেয়ে দেখা হয়েছে। বিয়ের আগে আমিও ওর বাসায় গিয়ে দেখে এসেছি। আলাদা ভাবে শান্তার সাথে বসার প্রস্তাব দুইপক্ষ থেকেই এসেছিল। আমিই বসতে চাইনি। মেয়ের বাবা সচিব। হজ্ব করা মানুষ। মেয়ের মা একটা স্কুলে পড়ায়। শান্তার পরিবার দেখেই আম্মা বশ হয়ে গেছেন। পাক্কা কথা দিয়ে ফেলেছিলেন। আলাদাভাবে বসলেও আমি কী কোনো ছুতায় এই বিয়ে ভাঙতে পারতাম?

নাহ।

তাই বসি নাই। বিয়ের পর বসবো ভেবেই কিছুটা রোমাঞ্চ বোধ করেছিলাম।

ভেবেছিলাম, পার্কে কিংবা রেস্টুরেন্টে বসে নয়া বউয়ের ধার কমাবো কেন? একেবারে বাসর ঘরেই বন্ধ দরজার অন্যপাশে দুইজনে বসব।

দেখবো যখন, ভালো করেই দেখবো। কিন্তু, কিন্তু... শাহানা এইটা কী বলল?

রাজপথ ছাড়িয়ে গাড়ি আমাদের মহল্লায় প্রবেশ করলো। মহল্লা থেকে অল্প দূরেই বাসা। লালনীল মরিচবাতিতে সম্পূর্ণ রাস্তাটা আলোকিত হয়ে আছে। চড়া ভলিউমে গান বাজছে। বউ নিয়ে গাড়ি এসেছে টের পেয়েই অপেক্ষমান মানুষেরা ছুটে এসেছে।

গাড়ি থেকে নামলাম। শান্তাকেও হাতে ধরে নামানো হলো। শান্তার মাথা নিচু হয়ে আছে। অবাঞ্চিত শাড়ি ও গহনার ভারে জর্জরিত সে? নাকি অন্য কোনো ছেলের কথা ভাবছে? প্রেম ছিল আর কারও সাথে?

এইদিকে আমি, যুগজনমের কানা, যুগজনমের তৃষ্ণা আমার বুকে। সেই নাইন টেনে পড়ার সময় একটা মেয়েকে পছন্দ করেছিলাম। সে আমাকে ম্যান্দামারা বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল। ভালো ছেলেরা, মানে অতিরিক্ত রকমের ভালো ছেলেরা কিছুটা ম্যান্দামারাই হয় বটে। মেয়েদের সাথে চটুল হাসির কথা বলে, চুটকি বাজিয়ে আড্ডা দিয়ে মুগ্ধ করার ক্ষমতা আমার ছিল না।

তবে বিশ্বাস ছিল, পড়াশোনা শেষ করে ভালো একটা জব পেলে, ভালো একটা মেয়ের দেহ ও মনের মালিকানা আমি নিশ্চয়ই পাব। নিজের দেহ এবং মনের মালিকানাও যে ওর জন্যে তুলে রেখেছিলাম আমি।

বাসায় ফেরার পর বধু-বরণ সংক্রান্ত আরও কিছু আনুষ্ঠানিকতা ছিল। খানাপিনার ব্যাপার ছিল।

বন্ধু পিয়াস এবং হামীম এই পুরোটা সময়জুড়ে আমার সাথে ছিল-

আজ রাতের উত্তেজনাকর ঘটনাবলীর ইঙ্গিত করে আমাকে নিচু স্বরে একটু পরপর চটকাচ্ছিল,

"কী মাম্মা? খুব খুশি, তাই?!"

"একেবারে কাঁপায়ে দিবা, অকে?"

নিঃসন্দেহে অশ্লীল ইঙ্গিত। কিন্তু মনে যদি আমার দ্বিধা না থাকতো, এইগুলাও হয়তো এনজয় করতাম আজ। পারছিলাম না। শাহানার কথাটা, ছোট্ট একটা বাক্য, আমাকে একেবারে বিদ্ধ করে দিয়েছে।

অনেক রাতে...

রাত তখন দেড়টা...

শান্তা বসে আছে, ফুলে ফুলে সাজানো ফুল শয্যায়... ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিলাম আমি। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম, শান্তার কাছে। বসলাম। শান্তা মুখ তুলে থাকালো। ওর গায়ে এখনও সেই রঙিন পাড়ের শাড়ি, স্বর্ণের অলঙ্কারে ঠাসা গলা, কান, নাক, কপাল...

গলা ঝেড়ে কাশি দিলাম। উহুম, উহুম! শান্তা এইবার পূর্ণ চোখে তাকালো আমার দিকে। বললাম,

"ভণিতা করে লাভ নেই। ফেরার পথে যেভাবেই হোক, একটা কথা আমার কানে এসেছে-"

শান্তার চোখ জোড়া বড় হয়ে গেলো। কী সুন্দর, টলটলে জলভরা কালো চোখ! চোখের পাতায়, পাপড়িগুলো যেন গর্ভবর্তী মেঘ। নাকের চূড়ায় একটু একটু ঘাম জমেছে... আমার খুব লোভ হলো...

অসমাপ্ত বাক্যটা শেষ করলাম না। শান্তা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে জানতে চাইল, "কি?"

একবার মনে হলো জিজ্ঞেস করে দরকার নেই। এমন ডাগর চোখের, মায়াবী মুখের একটা মেয়েকে যদি হাতছাড়া করতে হয়, কেঁচো কুড়তে যদি একটা সাপ...

তবুও সাহস করে বলে ফেললাম,"বিয়েতে তুমি নাকি কবুল বলোনি।"

শান্তা তাকিয়ে রইল। শীতল চোখে। আমি বললাম, "ভয় পাবার দরকার নেই। উত্তর দাও।"

শান্তা উত্তর দিল, সাপিনীর মতোই শান্ত স্বরে উত্তর দিলো, "হ্যাঁ। কী করবেন এখন আপনি?"

"প্রেম ছিল কারও সাথে? ছেলেটা কে?"

"চিনবেন না।"

"নিজের প্রেমিককে পথে বসিয়ে আমাকে বিয়ে করলে কেন?"

"উপায় ছিল না। আব্বা বলেছে, বিয়েতে রাজি না হলে জবাই করে ফেলবে।"

"প্রেমিক কী করে?"

"জেনে দরকার আছে কোনো? আপনাদের মতো এলিট কিছু নয়। গল্প কবিতা লিখে। ভিক্ষাবৃত্তি করে বেড়ায়..."

শান্তার নাকের ডগায় ঘামের বিন্দুগুলি আরও বেশি ঘন ও গভীর হচ্ছিল। রাগে ও অভিমানে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেলো ওর দেহে।

জানতে চাইলাম,"আমাকে ঠকালে কেন?"

"আপনাকে ঠকাবো কেন? কি চান বলুন? বুক দেখবেন? জামা খুলি?"

শান্ত কণ্ঠে বললাম,"আচ্ছা, খোল!"

শান্তা বিশ্বাস করতে পারলো না আমার কথাটা। স্থির চোখে তাকিয়ে রইল। আমি হাত হাত বাড়িয়ে আহবান জানালাম,"এসো, তোমাকে ভেতরে বাইরে ব্যবচ্ছেদ করব আজ..."

শান্তা কেঁপে উঠল। তাতে কিচ্ছু যায় আসে না আমার। এই মেয়ে এক কবি কিংবা লেখককে ভালোবেসেছিল। এর থেকেই বোঝা যায়, শান্তা একটা বোকা মেয়ে। বোকা ছাড়া কেউ ভাতেমরা কবি সাহিত্যিকদের সাথে প্রেম করে?

ফুলশয্যায় বসেই কল্পনা করছিলাম, ওর হাভাতে প্রেমিকটা নিশ্চয়ই এখন এই মধ্যরাতে কোন পার্কে কিংবা নিজের রুমেই ছেঁড়া একটা বিছানার উপর পা ছড়িয়ে বসে সস্তা বিড়ি টানছে আর নীরবে চোখের জল ফেলছে... বোকাচণ্ডের দল!

"শান্তা।"

"হু।"

"প্রেমিকের কাছে ফেরত যেতে চাও? ব্যবস্থা করে দিব?"

শান্তা ঘৃণায় কেঁপে উঠে বলল,"না, নাহ!"

আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এই মেয়ে বাবার ভয়ে নয়, নিজেই বিরক্ত হয়ে প্রেমিকের বুকে লাত্থি বসিয়েছে।

একটুখানি কাছে গিয়ে মায়াবী স্বরে বললাম,"তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছি, কষ্ট নিও না। এসো, তোমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরার একটা সুযোগ দাও আমাকে। দীর্ঘ জীবনে কখনও কোন মেয়েকে জড়িয়ে ধরার সুযোগ পাই নি, আমি শুধু সিনেমা দেখেছি, আর কল্পনা করেছি...."

আমার এই ঘোর লাগা স্বর শুনেই হয়তো শান্তার মায়া কিংবা দয়া হল। নরম স্বরে বলল,"আমি কিন্তু কবুল বলেই বিয়ে করছি তোমাকে। খোদার কসম..."

বুকের উপর থেকে একটা পাথর যেনো নেমে গেলো। শান্তাকে আরও একটু কাছে নিয়ে আরও একটু ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে ধরে, ব্লাউজের বোতামে হাত দিলাম...

***

দুইশো মাইল দূরে নির্জন নদীর চড়ায় বসে একাকী এক যুবক বিড়ি টানছে তখন। নিজেকে শুয়ারের বাচ্চা বলে গালি দিচ্ছে আর হাউমাউ করে কাঁদতে গিয়ে খিকখিক করে হেসে উঠছে।

যুবকের নাম... থাক, নাম জেনে লাভ কী?...

 

©

মুহম্মদ নিজাম

বাংলাভূমি

Tags:

About author
আমি গল্প এবং বই প্রেমিক একজন মানুষ। গল্প এবং বই পড়তে খুবই ভালোবাসি। যেখানেই যে গল্প অথবা কাহিনী খুজে পাই সেগুলো সংগ্রহ করি এবং আপনাদের সাথে শেয়ার করার চেষ্টা করি। আমি নিজেও কয়েকটি গল্প লিখেছি তবে সেগুলোর সংখ্যাটা খুবই সামান্য।