Search

গল্প (অপেক্ষা)

  • Share this:

মন্ত্রী সাহেবের মেজাজ গরম। আখাউড়ায় দুটি বগী লাইনচ্যুত। সাংবাদিকরা বাড়ির সামনে ভিড় করেছে। হতাহতের খবর এখনও অজানা। পুলিশকে ফোন করা হয়েছে। মন্ত্রী সাহেবের একটা খারাপ অভ্যাস আছে। মেজাজ গরম হলে ঠিকমত কথা বলতে পারেন না। দু তিনটা শব্দ মিলে মিশে একটা হয়ে যায় । আবার একটা শব্দ ভেঙ্গে দু তিনটা হয়ে যায়। অভ্যাসটি আগে ছিল না। বছর তিনেক আগে একটি জনসভায় বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। নেতা কর্মীদের চাপে মঞ্চ ভেঙ্গে নিচে পড়লেন। উত্তেজিত হয়ে নেতা কর্মীদের গালাগাল করলেন। কিন্তু গালাগালের শব্দগুলো ক্রমশ ভেঙ্গে গেল। খারাপ অভ্যাসটির শুরু সেখানেই।

মন্ত্রী সাহেবের জন্য আরেকটি খারাপ খবর এসেছে। খবরটি বেডরুম থেকে এসেছে। ছোট মেয়ের মন খারাপ । একদম কিছুই ভালো লাগছে না। ইতোমধ্যে রুমের জিনিসপত্র সবকিছু ভেঙ্গে চুড়মাড় করেছে।

এখনই জার্মানি চলে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে। মন্ত্রী সাহেব রেলের বগীর কথা ভুলে গেলেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

- শান্ত হও মামনি। বাসায় যা কিছু আছে তুমি ভেঙ্গে ফেলো, তবু জার্মানি যাওয়ার কথা মুখেও এনো না।

ছোট মেয়ের নাম রোদেলা। দু মাস হলো দেশে এসেছে। গোটা তিনেক বড় বড় ডিগ্রী এনেছে জার্মানি থেকে।

রোদেলা খুব উচ্চস্বরে চেচামেচি করছে। মেয়েটার স্বভাব আগে তো এমন ছিল না। হঠাৎ করে কী হল? শান্ত স্বভাবের মেয়েরা একবার রেগে গেলে তুলকালাম কান্ড ঘটায়।

রাগ কিছুতেই কমছে না। মন্ত্রীসাহেব কী করবেন বুঝতে পারেন না। রেলের খবরের চেয়ে মেয়ের মনের খবর তাঁর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

মেয়েকে কাছে বসালেন। আদর করলেন। চোখের পানি মুছে দিলেন। প্রতিটি বাবার দুটি পৃথিবী থাকে। একটিতে বাস করে তাঁর কন্যা, অন্যটিতে বাকি সবাই।

রোদেলা শান্ত হয়েছে। বাবার কোলে মাথা রাখলো। মন্ত্রী সাহেব একটু স্বস্তি পেলেন। কিন্তু এই স্বস্তি তাঁর কপালে দির্ঘায়িত হল না। বাড়ির সামনে বেশ হইচই পড়লো। রেল দূর্ঘটনা নিয়ে রেল মন্ত্রীর বিবৃতি চায় সাংবাদিকরা।

বাবার মন্ত্রীত্ব,দেশ,দেশের রাজনীতি এসব নিয়ে রোদেলার কোন ভাবনা নেই।

বারান্দায় বসে আছে রোদেলা। আজ কেন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। কোন কিছুতে একদম মনোযোগ নেই। চিৎকার দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।

বাবাকে বারান্দায় ডাকলো রোদেলা। মন্ত্রী সাহেব ব্রিফিং এর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। রোদেলার ডাক শুনতে পাননি। আবারো বাবাকে ডাকলো। বাবা আসছে না। রাগে, ক্ষোভে বারান্দার ফুলের টব গুলো চুড়মাড় করে দিলো রোদেলা। শব্দ শুনে হাজির হলেন মন্ত্রী সাহেব। কী করবেন বুঝতে পারেন না। তবে এইটুকু বুঝতে পেরেছেন , মন্ত্রীত্ব হারানোর জন্য এরকম একটি মেয়েই যথেষ্ট ।

- কী হয়েছে মামনি?

- বাবা, আমি এ বাসায় আর থাকতে চাই না। এক্ষুনি দূরে কোথাও চলে যাব।

মন্ত্রী সাহেব বললেন,

- শান্ত হও মামনি। এ বাসায় তুমি না থাকলে আমরা কেউ থাকবো না। চলো সবাই মিলে ধানমন্ডির বাড়িতে যাই।

- তোমাদের কাউকে নিব না । আমি একা যেতে চাই।

মন্ত্রী সাহেবের পাশে তাঁর ব্যাক্তিগত সহকারী এসে হাজির হলেন।

- স্যার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে ফোন এসেছে। রেলের ব্যাপারে কথা বলবে।

মন্ত্রী সাহেবের শরীর থেকে ঘাম বের হচ্ছে। মনে মনে একটা প্রতিজ্ঞা নিলেন। মন্ত্রীত্ব চলে গেলেও ব্যর্থতার দায় স্বীকার করবেন না।

রোদেলা চিৎকার দিয়ে বললো,

-বাবা, আমি এখানে থাকবো না।

চিৎকার শুনে মন্ত্রীর সহকারী বারান্দা থেকে চলে গেল।মন্ত্রী সাহেব গেলেন না। মেয়েকে বুঝানোর চেষ্টা করছেন।

-মামনি কয়েকদিনের জন্য ঢাকার বাইরে থেকে ঘুরে এসো।

বাবার প্রস্তাবে রাজি হলো রোদেলা। মন্ত্রী সাহেব যে পরিস্থিতিতে আছেন তাতে যেকোন কিছুর বিনিময়ে মেয়েকে শান্ত করতে হবে। রোদেলা ইচ্ছা করলে এই সুযোগটি লুফে নিতে পারতো। কিন্তু সব সুযোগ লুফে নেয়ার জন্য নয়। কিছু তুলে রাখতে হয় ভবিষ্যতের জন্য।

রুপগঞ্জে একটি বাগান-বাড়ি আছে মন্ত্রী সাহেবের। নাম, ' "দ্যা রোদেলা হ্যাভেন" ।

মন্ত্রী সাহেব "রোদেলা হ্যাভেন" এর সকল কর্মচারিকে ফোন করে বলেছেন, তোমরা রেডি থেকো। তোমাদের একজন গেষ্ট যাচ্ছে। আপ্যায়নে কোন ঘাটতি থাকলে কারো চাকরি থাকবেনা।

রোদেলা বাসা থেকে বের হল। সাথে আছে ড্রাইভার নাসির উদ্দীন।

রোদেলা কখনও রুপগঞ্জে যায়নি। আজই প্রথম।

বিকেল ৩ টা বাজে। 'দ্যা রোদেলা হ্যাভেন' এর সামনে গাড়ি থামলো। অভ্যর্থনা জানাতে দাঁড়িয়ে আছে বারো জন। এগারো জনের হাতে এগারো রকমের ফুল। একজনের হাতে একটা ছাতা। যা রোদ পড়েছে তাতে শরীর পুড়ে যাওয়ার উপক্রম। বারো জনের কান্ড দেখে রোদেলার মন ভালো হয়ে গেল। মেয়েদের মনে সব সময় একধরনের অদ্ভূত ঢেউ খেলা করে। যে ঢেউ কখনও উঁচু আবার কখনও সমান্তরালে প্রবাহিত হয়।

ভিতরে প্রবেশ করলো রোদেলা। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ালেন বারো জন। সবাই নিজ নিজ পরিচয় দিচ্ছেন।

আমি হাসমত মিয়া, আমি গেটের দায়িত্বে আছি।

আমি গুলজার, আমি ইলেকট্রিশিয়ান ।

আমি কেরামত, আমি ফুল বাগানে কাজ করি।

আমি দেবাশিষ, আমি পাখিদের দেখাশুনা করি।

আমি পনু, আমি রান্নার দায়িত্বে আছি।

আমি কাশেম, আমার নির্দিষ্ট কাজ নেই। যখন যা পাই তাই করি।

আমি মুনসুর, পুকুরে মাছের দেখাশোনা করি।

আমি আলেয়া, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নের দায়িত্বে আছি।

আমি বিলকিস, নার্সারিতে কাজ করি।

আমি আ: জব্বার , মসজিদের খেদমত করি।

আমি সগীর, আমি গাড়ি চালাই।

আমি মোকছেদ মিয়া, আমি এই বাড়ির কেয়ার টেকার । আপনার যখন যা কিছু দরকার হবে, আমাকে বলবেন । আমি আপনার জন্য সবকিছু করতে প্রস্তুত।

সবার ব্যবহারে খুব খুশি হল রোদেলা। এ বাড়িতে রোদেলার জন্য আলাদা কটেজ আছে। কটেজে না গিয়ে চারদিকটা একটু ঘুরে দেখতে বের হল। সাথে মোকছেদ মিয়া আছে।

প্রথমেই চোখ পড়লো একটি দিঘীর উপর। নাম মায়ার দিঘী। পানিতে থই থই। দিঘীর চারপাশে নারিকেল গাছের সারি। পুরো দিঘী ঘুরতেই ক্লান্ত হয়ে পড়লো রোদেলা। মোকছেদ বললো,

- ম্যাডাম, আপনি মনে হয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। কটেজে চলুন। বিশ্রাম নিন। আপনার জন্য খাবার তৈরি আছে।

- আমার অনুমতি ছাড়া খাবার রেডি হলো কীভাবে?

- ম্যাডাম, আপনার পছন্দের সব খাবার রান্না করা হয়েছে। আপনি যা চাইবেন তাই খাবেন।

রোদেলা অবাক হলো। শুধু দিঘী ঘুরতে দু ঘন্টা সময় লেগেছে। পুরো বাগান বাড়ি ঘুরতে কয়দিন লাগে কে জানে?

কটেজটি বেশ গোছানো। ভিতরে ঢোকা মাত্রই যেন মন জুড়িয়ে গেল। সকালের সেই গরম মেজাজ এখন শীতলতায় পরিণত হয়েছে। মেজাজের সাথে পরিবেশের বেশ ভালো একটি সম্পর্ক রয়েছে।

কটেজের সামনে একটি লেক আছে। লেক পানিতে ভরপুর। বারান্দায় বসে লেকের দিকে তাকিয়ে আছে রোদেলা। পিছনে কেউ একজন গলা খাকাড়ি দিচ্ছে।

পিছন ফিরে তাকালো রোদেলা। চিকন একটা লোক । গায়ের রং কালো । মাথায় ছোট ছোট চুল। গায়ে একটি খয়েরি রং এর জামা। শরীরের সাথে জামাটি বেশ বেমানান। দেখলে মনে হয় অন্য কারো জামা পড়ে এসেছে। লোকটির নাম কাশেম। নির্দিষ্ট কোন কাজ নেই তাঁর। যখন যা পায় তাই করে। লোকটি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রোদেলা বললো,

-কী যেন নাম আপনার?

- কাশেম।

-কিছু বলতে চান?

- ম্যাডাম, আপনার খাবার প্রস্তুত আছে। আপনি অনুমতি দিলে নিয়ে আসবো।

- জ্বী, নিয়ে আসুন।

-ম্যাডাম, বেয়াদবি না নিলে একটি কথা বলতাম।

রোদেলা কিছুটা বিরক্ত হয়েছে। এত ম্যাডাম ম্যাডাম করে কেন লোকটা।

- কী বলবেন?

কাশেম মাথা নিচু করে বললো,

-ম্যাডাম, আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন।

- কেন, তুমি করে বলবো কেন? আমার যা খুশি তাই বলবো।

রোদেলার কথায় খুব ভয় পেল কাশেম। যদি মাথা আরো নিচু করতে পারতো তবে তাই করতো কাশেম।

কাপা কাপা গলায় কাশেম বললো,

- সরি ম্যাডাম।

রোদেলার মাথা গরম হতে শুরু করেছে। চোখ লাল করে বললো,

- আমার সাথে একদম সরি বলবেনা। আমি এই শব্দটা খুব অপছন্দ করি। যাও এখান থেকে।

রোদেলার চিৎকার চেচামেচি দূরে বসে দেখছে মনসুর ও আলেয়া। এরা স্বামী-স্ত্রী। কোন ছেলে মেয়ে নেই। একসাথে চাকরি করে এখানে। বেশ সুখেই দিন কাটে এঁদের।

কাশেমের শরীর থেকে ঘাম ঝরছে। চাকরি জীবনে এই প্রথমবার ধমক খেয়েছে। তিনমাস হলো এ বাগান বাড়িতে চাকরি পেয়েছে। এখনো বিয়ে করেনি। পড়ালেখা করেছে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত । এখানে আট হাজার টাকা বেতনে চাকরি করে। থাকা খাওয়া ফ্রি।

লেকের পাশে লাল নীল বাতি জ্বালানো হয়েছে। বাতির একটা প্রতিচ্ছবি পড়েছে লেকের পানিতে। পাশেই চেয়ার টেবিল দেয়া আছে। এখানেই আরাম করে বসে আছে রোদেলা। একটু পর পর বাতাসের ঝাপটা এসে খোলা চুলকে এলোমেলো করে দেয়।

কাশেমকে একটু বেশিই বলা হয়েছে। এসব ভাবছে রোদেলা। খাবার চলে এসেছে। কাশেম মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

হরেক রকমের খাবার। একজনের জন্য এত খাবার রোদেলা কোন দিন দেখেনি। হঠাৎ মন্ত্রী সাহেবের ফোন।

- কেমন লাগছে মামনি? খাবার পছন্দ হয়েছে?

- বাবা, সবগুলো আমার পছন্দের খাবার।কিন্তু এত খাবার একসাথে কীভাবে খাবো?

- বাগান বাড়ি কেমন লেগেছে?

- এখনো ঘুরে দেখিনি।

মোবাইলে কথা বলতে বলতে খেতে শুরু করলো রোদেলা। অপর প্রান্ত থেকে মন্ত্রী সাহেব বললেন,

- মামনি, 'দ্যা রোদেলা হ্যাভেন' তোমাকে গিফট করলাম।পঁচিশতম জন্মদিনের উপহার।

- ওয়াও!! থ্যাংকস অ্যা লট মাই ডিয়ার পাপা।

-মামনি , তুমি খাও। খেয়ে বিশ্রাম কর। পরে কথা হবে।

- ঠিক আছে বাবা।

ফোন রাখলো রোদেলা । সবগুলো আইটেম থেকে একটু একটু টেষ্ট করলো।

পরেরদিন সকালে,

পাখির কিচিরমিচিরে ঘুম ভাঙলো রোদেলার। কটেজের বাইরে মোকছেদ মিয়া দাঁড়িয়ে আছে।

রোদেলা বাইরে বের হতেই মোকছেদ মিয়া বললো,

- গুড মর্নিং ম্যাডাম।

রোদেলা বললো,

- কী যেন নাম আপনার?

- মোকছেদ মিয়া। আমি আপনাদের কেয়ার টেকার।

রোদেলা কিছু না বলে লেকের পানির দিকে তাকিয়ে রইলো। একটু দূরে কাশেম দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। ম্যাডাম চা নাকি কফি খাবেন, এটা বুঝার চেষ্টা করছে।

রোদেলা বললো,

-মোকছেদ সাহেব, আমি পুরো বাগান বাড়িটি ঘুরে দেখতে চাই।

- জ্বী ম্যাডাম, আমি গাড়ির ব্যবস্থা করছি।

- গাড়ি লাগবেনা। আমি পায়ে হেঁটে দেখতে চাই ।

- ঠিক আছে ম্যাডাম।

মোকছেদ মিয়া চলে যাচ্ছে। পিছন থেকে রোদেলা ডাকলো,

- মোকছেদ সাহেব, কাশেমকে একটু পাঠান এখানে।

মোকছেদ বললো,

- এক্ষুনি পাঠাচ্ছি ম্যাডাম।

কাশেম দরজার সামনে সকালের নাস্তা নিয়ে অপেক্ষা করছে।

কটেজের সাথে একটি বেশ বড় সুইমিং পুল আছে। সুইমিং পুলের চারপাশটা উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। রোদেলা সুইমিং পুলের ভিতরটা দেখছে আর বাবার রুচির কথা ভাবছে। এখন পর্যন্ত যা যা দেখা হয়েছে তা অসাধারণ লেগেছে।

রাজনীতিবিদদের রুচিবোধ এমন হতে পারে তা রোদেলার জানা ছিল না। বাবা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মেয়ের জন্য করেছেন এসব।

রোদেলা সকালের নাস্তা শেষ করলো। কাশেম দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। রোদেলা বললো,

- কাশেম, পুরো বাগান বাড়িটি আমি ঘুরে দেখতে চাই। তুমি আমার সাথে থাকবে।

- জ্বী ম্যাডাম।

কাশেম খুব ইতস্তত বোধ করছে। ম্যাডামের দেখাশোনার দায়িত্বটা তাকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু কিছুই করার নেই। চাকরি টিকিয়ে রাখতে হলে মোকছেদ মিয়ার সব ধরনের চাপ সহ্য করতে হবে।

কাশেমের হাতে একটি ব্যাগ । ব্যাগটি রোদেলার।

ব্যাগের মধ্যে একটি পানির বোতল, একটি তোয়ালে ও একটি ছাতা। রোদেলার হাতে একটি ক্যামেরা। হাঁটতে শুরু করলো দুজন। রোদেলা সামনে, কাশেম পিছনে।

সামনে পেয়ারা বাগান। গাছ ভর্তি পেয়ারা পেঁকে আছে। গাছের নিচে পড়ে আছে অনেক পেয়ারা।

কাশেম বললো,

- ম্যাডাম, বাগানে যত পেয়ারা দেখছেন, এগুলো মানুষের জন্য নয়। শুধু পাখিদের জন্য। আমাদের স্যার মানে আপনার বাবা বলে দিয়েছেন, কোন মানুষ যেন এতে হাত না দেয়।

রোদেলা বললো,

- আমি এ বাগানের পেয়ারা খেতে চাই। তুমি গাছে চড়ে পেরে দিবে।

কাশেম পেয়ারা গাছে চড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। চারদিকে পাখপাখালির আনাগোনা। কোথাও জনমানব নেই। শুধু গাছ আর পাখি।

গোটা পাঁচেক পেয়ারা পাড়লো কাশেম।

রোদেলা বেশ মজা করে খাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে গোলাপ বাগানে চলে এসেছে দুজন। বাগানে কেরামত আলী কাজ করছেন। রোদেলাকে দেখে গোটা দশেক লাল গোলাপ উপহার দিলেন। এতবড় গোলাপ বাগান নিজের চোখে কখনো দেখেনি রোদেলা। এটা তাঁর নিজের বাগান ভাবতে অবাক লাগছে।

আবারো হাঁটতে শুরু করলো দুজন। রোদেলা জিজ্ঞেস করলো,

- কাশেম , তুমি বিয়ে করেছো?

- জ্বী না , করিনি ম্যাডাম।

- এখনো করোনি কেন?

কাশেম কিছু না বলে মাথা নিচু করে হাঁটছে। মৃদু বাতাস বইছে। হঠাৎ রোদেলা বললো,

- আমাকে কেমন লাগছে? সুন্দর নাকি কুৎসিত?

মাথা নিচু করে কাশেম বললো-সুন্দর লাগছে ম্যাডাম।

- আমি সুন্দর তুমি বুঝলে কীভাবে? তুমি তো সারাক্ষণ মাথা নিচু করে থাকো।

এখন কাশেমের কী বলা উচিত? বলা উচিত- ম্যাডাম, নারীর সৌন্দর্য্য কখনো লুকানো থাকেনা। মাথা নিচু থাকলেও মনের চোখ দিয়ে সব দেখা যায় । কিন্তু কাশেম কিছু না বলে মাথা নিচু করে হাঁটছে।

এমন অনেক পরিস্থতি আছে যখন অন্তরে হাজোরো কথা থাকলেও নির্বাক থাকতে হয়।

রোদেলা বললো,

- আরেকটি কথা। তুমি সারাক্ষণ মাথা নিচু করে থাকো কেন? মাথা নিচু করে থাকা আমার একদম অপছন্দ।

গতকাল রাতের ম্যাডাম ও আজকের ম্যাডামের মধ্যে যে বিস্তর পার্থক্য তার কারন খুঁজছে কাশেম।

রোদেলা বললো,

- চলো কটেজে ফিরে যাই। বাকিটা বিকেলে ঘুরবো।

কটেজে ফিরে লেকের পাশে দাঁড়ালো কিছুক্ষণ। লেকের পানিতে কিছু মাছ দেখা যাচ্ছে। রোদেলা বললো,

- এগুলো কী মাছ?

- তেলাপিয়া।

- তেলাপিয়া ইংরেজী কী?

- জানিনা ম্যাডাম।

দুপুরের খাবারের পরিস্থিতি কী তা কাশেম জানে না। তাই মোকছেদ মিয়ার রুমে গিয়ে একটু খবর নেয়া যাক। বাগান বাড়িতে মোকছেদ মিয়ার একটি অফিসও আছে।

- মোকছেদ ভাই, ম্যাডামের খাবার কি রেডি হয়েছে?

- হ্যাঁ, হয়েছে।

কাশেম নিচু গলায় মোকছেদের কাছে জিজ্ঞেস করলো,

- মোকছেদ ভাই, তেলাপিয়া মাছ ইংরেজী কী?

- জানিনা। কিন্তু কেন?

- এমনি জিজ্ঞেস করলাম

মোকছেদ মিয়া হেসে হেসে বললো,

- ম্যাডামের ডিউটি করতে দিয়েছি, বকশিস পাইলে আমারেও ভাগ দিও মিয়া।

কাশেম কিছু না বলে রান্নাঘরে চলে গেল।

সন্ধ্যায়,

রোদেলা সুইমিং পুলে বসে আরাম করছে। চারদিকে অন্ধকার। শুধু পানির মধ্যে আলো জ্বলছে। দেখতে বেশ অদ্ভুত লাগছে। কাশেমকে ডাকলো রোদেলা।

কাশেম সুইমিং পুলের গেটে দাঁড়িয়ে আছে। রোদেলা বললো,

- ভিতরে এসো।

কাশেম ভিতরে যাচ্ছে না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

- কী হল, ভিতরে এসো!

- ম্যাডাম, আমার তো ভিতরে আসার অনুমতি নেই।

রোদেলার মেজাজ গরম হতে লাগলো।

- আমি তোমাকে আসতে বললে আবার কার অনুমতি লাগবে?

ধমক খেয়ে সুইমিং পুলের ভিতরে ঢুকলো কাশেম। রোদেলা বসতে বললো। কাশেম বসলো না। মাথা নিচু করে পানির দিকে তাকিয়ে আছে। রোদেলা বললো,

- কাশেম, তুমি সাঁতার কাটতে পারো?

- জ্বী ম্যাডাম , পারি।

- খুব ভালো। তাহলে পানিতে নামো। আমি কখনো কাউকে সাঁতার কাটতে দেখিনি।

ম্যাডাম ঠাট্টা করে বলেছে নাকি সত্যি সত্যি বলেছে কাশেম বুঝতে পারেনি। তাই এখনো পানির দিকেই তাকিয়ে আছে।

রোদেলা বললো,

- কী হলো, নামছো না কেন?

কাশেম আর দেরি না করে পানিতে নেমে পড়লো। সাঁতার কাটতে শুরু করলো।

এবার রোদেলাও পানিতে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ম্যাডামের এমন কান্ড দেখে সুইমিং পুলের এক কোনে দাঁড়িয়ে রইলো কাশেম। রোদেলা বললো,

- আমাকে সাঁতার শিখাতে পারবে?

- না ম্যাডাম, পারবো না।

- কেন পারবেনা?

কাশেম কিছু বলছে না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রোদেলা বললো,

- না পারলে দাঁড়িয়ে আছো কেন? এক্ষুনি চলে যাও এখান থেকে।

ধমক খেয়ে সুইমিং পুল থেকে বের হয়ে গেলো কাশেম।

মনসুর ও বিলকিস দূর থেকে দেখছে। তাদের মনে সন্দেহের দানা বাঁধতে লাগলো।

দুই দিন পর,

লেকের সামনে রোদেলা বসে বসে আরাম করছে। কাশেম এসে বললো,

- আমাকে ডেকেছেন ম্যাডাম?

রোদেলা বললো,

- বৃষ্টি হবে কবে বলতে পারো?

- ঠিক বলতে পারবো না । তবে দু একদিনের মধ্যে হতে পারে।

রোদেলা কী যেন ভাবছে। হঠাৎ বললো,

-বাড়ির সবাইকে এক সপ্তাহের জন্য ছুটি দিয়ে দাও। শুধু তোমার ছুটি নেই। তুমি আর আমি বৃষ্টিতে ভিজবো।

রোদেলার কথা শুনে কাশেম যেন ভিড়মি খেলো। হঠাৎ চোখে সরষে ফুল দেখতে লাগলো। বড়লোকের কথায় ও কাজে প্রায়ই একটু আধটু পাগলামি থাকে। এর মাত্রা যে এত বেশি হতে পারে তা কাশেমের জানা ছিল না।

রোদেলা আবারো বললো,

- এক্ষুনি যাও। সবাইকে ছুটি দিয়ে দাও।

- কী বলছেন এসব ম্যাডাম? আমি কীভাবে ছুটি দিব? এসব বললে আমার তো চাকরি থাকবে না ।

রোদেলা অন্যমনষ্ক হয়ে বললো,

-যা বলেছি তাই করো। না হলে আমিই তোমাকে ছাটাই করে দিবো।

এ কেমন পরীক্ষায় পড়লো কাশেম? এই ঝুকিপূর্ণ চাকরি করার চেয়ে ডাল -ভাত খেয়ে জীবন ধারণ করা ভালো।

ম্যাডাম যা শুরু করেছে তাতে চাকরি ও জীবন দুটিই ঝুকিপূর্ণ । এই মুহূর্তে চাকরির চেয়ে জীবন বাঁচানোই বুদ্ধিমানের কাজ। এখন কী করা উচিত? নিশ্চয়ই মোকছেদ মিয়া ভালো একটা সমাধান দিতে পারবেন। তাই দেরি না করে মোকছেদ মিয়ার অফিসের দিকে হাঁটতে লাগলো কাশেম।

মোকছেদ মিয়া ব্যাগ গোছাচ্ছেন। কাশেম বললো,

- মোকছেদ ভাই কী ব্যাপার, ব্যাগ গোছাচ্ছেন কেন?

মোকছেদ মিয়া হেসে হেসে বললো,

- আর ঢং কইরো না মিয়া। তুমি বাদে সবার ছুটির অর্ডার আসছে। তাই বাড়ি যাইতাছি। তুমি আরামে ডিউটি কইরো।

কাশেম অবাক হয়ে বললো,

- এসব কী বলছেন মোকছেদ ভাই? আমি চাকরি করবো না।

- কী যে কও মিয়া! তোমার রাজ কপাল! যাও যাও ম্যাডাম তোমাকে ডাকতাছে।

কাশেমের মাথা ঘুড়ছে। মোকছেদের কথার আগা মাথা কিছুই বুঝলো না।

ইতোমধ্যে বাড়ির সবাই গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। জীবনে প্রথমবার এত লম্বা ছুটি পেয়েছে। এর চেয়ে খুশির খবর আর কী হতে পারে!! শুধু কাশেমের ছুটি নেই। হয়তো তাঁর জন্য আরো ভালো কিছু অপেক্ষা করছে। কিন্তু এই ভালো কিছু নিয়ে কাশেম একদম ভাবতে চায় না।

এই মুহূর্তে 'দ্যা রোদেলা হ্যাভেন' এ দুজন মানুষের বসবাস। একজন মনিব, অন্যজন চাকর। অন্যভাবে বলতে গেলে দুজনই মানুষ। তবে এদের সবচেয়ে বড় পরিচয় একজন পুরুষ, অন্যজন নারী। এই বিশাল স্বর্গরাজ্যে বিপরীত লিঙ্গের দুটি প্রাণি। একজন যা ইচ্ছা তাই করতে পারে , কিন্তু অন্যজন শুধু হুকুম পালনে ব্যাস্ত।

বিকেলের দিকে হাঁটতে বের হবে রোদেলা। কাশেম রান্না ঘরে। ম্যাডামের জন্য চা তৈরি করছে। আজ পাখির খাঁচা দেখতে যাবে। খাঁচাটি বাগানের একদম পশ্চিম পাশে।

ফ্লাস্ক ভর্তি চা ও এক বোতল পানি নিয়ে রোদেলার পিছু পিছু হাঁটছে কাশেম।

হঠাৎ মন্ত্রী সাহেবের ফোন।

অপর প্রান্ত থেকে মন্ত্রী সাহেব বললেন,

- কেমন আছো মামনি?

- বাবা, আমি পাখি দেখছি। পরে ফোন করো।

ফোন রেখে পাখির খাঁচার সামনে দাঁড়ালো।

দেশি -বিদেশি মিলিয়ে হাজার খানেক পাখির সমারোহ। কিচিরমিচিরে মুখরিত চারদিক। একটি অদ্ভূত ইচ্ছে মাথায় আসলো রোদেলার। খাঁচার পাখিগুলোকে মুক্ত করে দিবে। যেই চিন্তা সেই কাজ।

- কাশেম !

- জ্বী ম্যাডাম।

- খাঁচার মুখ খুলে দাও।

- কী বলছেন ম্যাডাম ?

- যা বলছি তাই করো।

কাশেম অবাক দৃষ্টিতে রোদেলার দিকে তাকিয়ে রইলো। এ কোন পাগলের পাল্লায় পড়লো। মন্ত্রী সাহেব এসব জানলে না জানি কী করেন। রোদেলা ধমক দিয়ে বললো,

-আমার বাড়িতে কোন কিছু বন্দী থাকতে পারেনা । আমি সবাইকে মুক্তি দিতে চাই।

এখন কাশেমের বলা উচিত-ম্যাডাম আমাকে দয়া করে মুক্তি দিন। কিন্তু কাশেম তা না বলে রোদেলার হাস্যোজ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। যে মুখে পাপের কোন চিহ্ন নেই। আছে শুধুই মায়া। কাশেম হঠাৎ করেই যেন এই মায়ার জালে আটকা পড়লো। মায়া হলো বন্ধ দরজার মত,বার বার নক করলে এক সময় এ দরজা খুলবেই।

কাশেম খাঁচার দরজা খুলে দিল। এর পর যা ঘটলো তা দেখে কেঁদে ফেললো রোদেলা। মুক্তির আনন্দ যে কত মধুর তা এই পাখিরা ছাড়া আর কেউ জানেনা।

কাশেম রোদেলার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। একটু আগে যে চোখে আগুন দেখেছে । এখন সে চোখে শুধুই মায়ার খেলা। পৃথিবীতে মানুষের চোখের রং খুব তাড়াতাড়ি পরিবর্তন হয়। যা শুধুমাত্র কাছের মানুষরাই দেখতে পায়। তবে কাশেম কি রোদেলার কাছের মানুষ? মোটেই না । কাশেম ও রোদেলার মাঝে যোজন যোজন দুরত্ব। এসব ভেবে যেন চোখে জল এলো কাশেমের । একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাশেম বললো,

- ম্যাডাম, সন্ধ্যা হয়েছে । চলুন কটেজে ফিরে যাই।

রোদেলা মৃদু হেসে বললো,

- আজ ফিরে যাওয়ার জন্য আসিনি। আজ এই জঙ্গলে হাঁটবো সারা রাত। আঁধারের সাথে আজ করবো আলিঙ্গন।

কথা বলতে বলতে হো হো করে হেঁসে উঠলো রোদেলা। এ হাঁসির শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে কাশেমের কানে।

চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। দু একটি গাছে জোনাকী পোঁকার আলো দেখা যায়। রোদেলা বললো,

- কাশেম, জোনাকী পোঁকা ধরতে চাই। এনে দাও।

রোদেলার হুকুমগুলোকে কেন যেন আবদারের মত মনে হতে লাগলো কাশেমের কাছে। হুকুম পালনের চেয়ে আবদার মিটানোতেই বেশি আনন্দ।

গাছে চড়লো কাশেম। সাথে একটি পলিথিন। একটি একটি করে জোনাকী পোঁকা পলিথিনের মধ্যে ঢুকালো। এই মুহূর্তে পলিথিনটিকে একটি আলোক পিন্ডের মত মনে হয়। রোদেলার হাতে তুলে দিল। আলতো করে স্পর্শ করলো জোনাকী পোঁকাগুলোকে । এরপর একে একে সবগুলোকে মুক্ত করে দিল আকাশে।

চারদিকে ঘন অন্ধকার। দুজন হাঁটছে। একটু আগেও সামনে-পিছনে হেঁটেছে। কিন্তু কখন যে পাশাপাশি হাঁটা শুরু করেছে তা কেউই টের পায়নি। রোদেলা এই পরিবেশের সাথে একদম নতুন। অথচ দেখলে মনেই হয়না । মনে হয় যেন এই অন্ধকারই তাঁর একান্ত আপনজন।

একটা শীতল বাতাস বয়ে যাচ্ছে বাগানে । বাতাসের পরশে বেড়ে যায় হৃদয়ের আকুলতা। এই মুহূর্তে রোদেলা কী ভাবছে? কাশেম কী ভাবছে? এদের ভাবনা কী একই নাকি ভিন্ন। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ থাকলেও অনুভূতিতে কোনো ভেদাভেদ থাকে না। এটা সবার জন্য একই। ঝর ঝর শব্দ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। রোদেলা এটাই চেয়েছিলো। 'দ্যা রোদেলা হ্যাভেন' এ মাত্র দুজন মানুষ , সাথে আছে ঘন অন্ধকার ও মুষলধারে বৃষ্টি। এ ঘটনার পরিনতি কী হতে পারে তা দুজনেরই অজানা। রোদেলা বললো,

- কাশেম , গান গেতে পারো?

- না ম্যাডাম, পারিনা।

- তুমি কী পারো?

রোদেলার কথা শুনে কাশেম ভাবতে লাগলো- আসলে আমি তো কিছুই পারিনা। কাশেম সাহস করে জিজ্ঞেস করলো,

- ম্যাডাম আপনি গান গেতে পারেন?

বলামাত্রই গান গেতে শুরু করলো রোদেলা। দুঃখের বিষয় হলো কাশেম গানের আগা মাথা কিছুই বুঝলো না।

হাঁটতে হাঁটতে দিঘীর পাড়ে এসে পৌঁছলো দুজন। বৃষ্টির গতি আরো বাড়তে লাগলো।

কাশেম বললো,

- ম্যাডাম কটেছে চলুন। এত ভিজলে জ্বর হতে পারে।

- তোমার খারাপ লাগলে তুমি যেতে পারো। আমি সারারাত এই দিঘীর পাড়েই বসে থাকবো।

বৃষ্টি থামছে না। এমন একটি দিন জীবনে আসবে তা কখনো কল্পনাও করেনি কাশেম। সাদামাটা জীবনে এক ফোটা বৃষ্টি অনেক মূল্যবান। সে রাতে চোখের পাতা এক করেনি কেউ।

কিছুদিন পর,

সবাই যার যার কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। সুযোগ পেলেই সবাই কাশেমের সাথে ভাব জমাতে চায়। সবার শুধু জানার আগ্রহ। এক সপ্তাহে কী কী ঘটেছিলো তা জানার আগ্রহ। কাশেম এ ব্যাপারে মুখ খুলছে না।

রোদেলা মন ভালো করতে এখানে এসেছে। মন ভালো হয়েছে কিনা তা কে জানে? তবে দুদিনের জন্য এসে দীর্ঘদিন থাকার অর্থ নিশ্চয়ই খারাপ নয়।

কাশেমের কাজে খুব একটা মন নেই। সারাদিন ম্যাডামের কাছাকাছি থাকে। ম্যাডাম না ডাকলেও কাছে গিয়ে বসে থাকে। এসব নিয়ে অন্যরা বেশ হাসি মষ্করা করে।

রাতের আকাশে চাঁদ উঠেছে। নিজের চোখে একদম খাঁটি জ্যোৎস্না দেখার খুব ইচ্ছে রোদেলার। তাই আবারো একটা পাগলামির আশ্রয় নিলো। সবাইকে এক সপ্তাহের জন্য ছুটি দিলো। শুধু কাশেমের ছুটি নেই। আছে রোদেলার কাছাকাছি থাকার সুযোগ।

কাশেমের মাথায় একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। জ্যোৎস্না দেখতে হলে সবাইকে ছুটি দিতে হবে কেন? বরং সবাই থাকলে তো আরো বেশি মজা হবে। উত্তরে রোদেলা বললো,

- আমি বেশি মজা চাই না। আমি চাই তোমার সাথে জ্যোৎস্না দেখতে।

রোদেলার কথা শুনে যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেলো কাশেম। এমন উত্তর শুনে পুরোপুরি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো কাশেম।

আজ পূর্ণীমা । বাগান বাড়িতে রোদেলা ও কাশেম। হঠাৎ মন্ত্রী সাহেবের ফোন। অপর প্রান্ত থেকে বললেন,

- কেমন আছো মামনি?

- আমি ভালো আছি। চাঁদ দেখা নিয়ে একটু ব্যাস্ত আছি। তোমাকে পরে ফোন করছি।

কাশেম লেকের পাড়ে দাঁড়িয়ে রোদেলার জন্য অপেক্ষা করছে। রোদেলা কটেজ থেকে এখনো বের হয়নি। চাঁদের মৃদু আলো লেকের পানিতে পড়তে শুরু করেছে। মূল গেটের দিকে গাড়ির হর্ণ শুনতে পেলো কাশেম। এ সন্ধ্যা বেলায় আবার কে এলো? গেটের দিকে যাচ্ছে কাশেম।

গেট খুললো। এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। কাশেম বললো,

- কাকে চান?

- আমার নাম আদনান। আমি রোদেলার গেষ্ট ।

লোকটিকে ভিতরে ঢুকতে দেয়া উচিত কিনা তা কাশেমের মাথায় আসছে না। কিন্তু লোকটি দেখতে বেশ স্মার্ট। এত স্মার্ট লোককে দাঁড় করিয়ে রাখা অথবা ফিরিয়ে দেয়ার সাহস কাশেমের নেই। তাই বললো,

- ভিতরে আসুন স্যার।

লোকটি ভিতরে আসলো। চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখছে। 'দ্যা রোদেলা হ্যাভেন ' এ মনে হয় প্রথমবার এসেছে। এখানে যারা প্রথম আসে তারা সবাই এ রকম বোকা মানুষের মত এদিক সেদিক তাকিয়ে থাকে। কটেজের দিকে যাচ্ছে দুজন। হঠাৎ লোকটি বললো,

- তোমার নাম কী?

- আমার নাম কাশেম।

- রোদেলা কোন দিকে থাকে?

- ম্যাডাম কটেজে থাকে। আপনাকে সেদিকেই নিয়ে যাচ্ছি।

কাশেমের মনে হাজারো প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। লোকটি ম্যাডামের কী হন? হঠাৎ করে এখানে আসলো কেন? নিশ্চয়ই মন্ত্রী সাহেব পাঠিয়েছেন।

রোদেলা লেকের পাড়ে বসে এক দৃষ্টিতে পানির দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটি কোন কিছু না বলেই রোদেলার পাশে বসলো। কাশেম দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে সবকিছু।

আদনান আজই জার্মানী থেকে এসেছেন রোদেলাকে সারপ্রাইজ দিতে। কিন্তু রোদেলা মোটেও বিস্মিত হয়নি। আবার বিরক্তও হয়নি।

আদনান জিজ্ঞেস করলো,

- কেমন আছ?

- ভালো আছি। তুমি?

- আমি বেশ ভালো আছি।

কারো মুখে কোন কথা নেই। রোদেলা তাকিয়ে আছে চাঁদের দিকে, আদনান তাকিয়ে আছে রোদেলার দিকে এবং কাশেম তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে।

নীরবতা ভেঙ্গে আদনান বললো,

- আমি এসেছি এ জন্য তুমি খুশি হওনি?

রোদেলা মাথা নাড়লো। মাথা নাড়ানোর অর্থ হ্যাঁ বোধক নাকি না বোধক আদনান তা বুঝতে পারেনি।

চাঁদের আলো ধীরে ধীরে গাঢ় হতে লাগলো। আদনান বললো,

- আমি অনেক ক্লান্ত। ভিতরে চলো, বিশ্রাম নিবো।

-তুমি গিয়ে বিশ্রাম কর। আমি আজকে চাঁদ দেখবো।

আদনান এমন উত্তর আশা করেনি। আশা করছিলো এমন- ওহ্ সুইট হার্ট , চলো তোমাকে আদর করে ঘুম পাড়িয়ে দেই!

রোদেলা কাশেমকে বললো,

- কাশেম, এদিকে এসো।

কাশেম মাথা নিচু করে সামনে দাঁড়ালো।

- যাও আমাদের জন্য চা নিয়ে এসো।

আদনান বললো,

- সেদিনের ঘটনার জন্য সরি।।

রোদেলা কিছু বলছে না। কাশেম চা নিয়ে এসেছে। টেবিলের উপর দুটি কাপ। কেটলি থেকে ঢেলে দিচ্ছে। রোদেলা বললো,

- কাপ দুটি এনেছো কেন? তুমিও আমাদের সাথে চা খাবে। যাও আরো একটি কাপ নিয়ে এসো।

কথাটি শুনে আদনান রোদেলার দিকে তাকালো। কাশেম কিছু না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। রোদেলা ধমক দিয়ে বললো,

- কী হলো , দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও কাপ নিয়ে এসো।

কাশেম কাপ আনতে গেল। আদনান জিজ্ঞেস করলো,

- তোমাদের এখানে নাকি অনেক কর্মচারি । কাউকে তো দেখছি না।

- কাশেমকে নিয়ে জ্যোৎস্না দেখবো বলে সবাইকে ছুটি দিয়ে দিয়েছি।

আদনানের চোখ দুটি হঠাৎ বড় হয়ে গেল। রাগে শরীর গজ গজ করছে। রাগ লুকিয়ে হেঁসে হেঁসে বললো,

- তাহলে আমি নিশ্চয়ই এসে ডিস্টার্ব করলাম !

- অবশ্যই ডিস্টার্ব করেছো।

জার্মানি থেকে ভালোবাসার টানে এখানে এসেছে আদনান। স্বাভাবিকভাবে কোনো ধরনের অপমান তাঁর সহ্য হবে না। উঠে দাঁড়ালো আদনান। গেটের দিকে হাঁটা শুরু করলো। আদনান ভেবেছে রোদেলা হয়তো বলবে, আদনান কোথায় যাচ্ছ তুমি? চলে এসো। কিন্তু আদনানের ধারনা ভুল। রোদেলা ঠিক আগের মতই বসে আছে লেকের পাড়ে।

আদনান ঢাকায় ফিরে গেল। আদনানের সাথে রোদেলার বিয়ের কথা চলছে। এ ঘটনার পর বিয়ের কথা কতদূর পৌঁছাবে তা কে জানে?

কাশেম কাপ নিয়ে এসেছে। রোদেলা বললো,

- কাপ লগবেনা। দুটিই যথেষ্ট।

কাশেমকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিলো রোদেলা।

চাঁদের আলো গাঢ় হতে লাগলো। কাশেম জিজ্ঞেস করলো,

- স্যার কোথায়?

- চলে গেছে।

কেন এসেছিলেন আবার কেন চলে গেলেন এসবের কিছুই বুঝে উঠছে না কাশেম। বোঝার দরকারও নেই। সবকিছু সবাইকে না বুঝলেও চলে।

হাঁটতে হাঁটতে দুজন দিঘীর পাড়ে চলে এসেছে। চাঁদের আলো দিঘীর থই থই পানিতে পড়ে অন্যরকম এক সৌন্দর্য্যের সৃষ্টি করেছে। যে সৌন্দর্য্যে ডুব দিয়েছে দুজন। মুহূর্তের মধ্যে তাঁরা তাঁদের পরিচয় ভুলে গেলো। এদের মূল পরিচয় এরা নারী ও পুরুষ। চাঁদের আলোতে রোদেলার চোখ চিক চিক করছে। যে চোখের দিকে তাকানোর সাহস কাশেমের হয়তো নেই।

বাতাস বইছে। বাতাসে কী এক মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে যায় চারপাশে। যে গন্ধে নেশা ধরে যায় কাশেমের।

ধীরে ধীরে চাঁদের আলো ক্ষীন হতে লাগলো। মসজিদ থেকে ফজরের আজান শোনা যাচ্ছে। এবার কটেজে ফেরার পালা।

সকাল দশটায় ঘুম ভাঙলো কাশেমের। তড়িঘড়ি করে উঠলো। ঝটপট ম্যাডামের জন্য নাস্তা তৈরি করলো। নাস্তা নিয়ে কটেজের সামনে দাঁড়ালো। ম্যাডাম ভিতরে নেই। হয়তো আগেই উঠেছে। লেকের পাড়েও নেই ম্যাডাম। সুইমিং পুলের ভিতরে হয়তো আছেন। ঢোকার সাহস নেই তাই বাইরে অপেক্ষা করতে লাগলো।

গতরাতের কথা ভাবছে কাশেম। এই তুচ্ছ জীবনে এরকম আরেকটি রাত খুব প্রয়োজন। যে রাতকে আঁকড়ে ধরে হাজার বছর পার করা যায়।

অনেকক্ষণ হলো, ম্যাডাম বের হচ্ছে না। সাহস করে ভিতরে ঢুকলো। এখানেও নেই। কাশেম ভয় পেলো। এবার রোদেলার রুমে আসলো। টেবিলে একটি কাগজ পড়ে আছে। চিঠির মত দেখতে। ভাঁজ করা কাগজটি খুললো। এটা একটা চিঠি । ম্যাডামের হাতে লেখা।

কাশেম,

ভয় পেও না কাশেম। আমি নিরাপদে আছি। জীবনের শ্রেষ্ঠ রাতগুলো কাটালাম তোমার সাথে ।আদনানের সাথে আমার বিয়ের কথা চলছে। জানিনা সে কথা কতদূর ফলপ্রসু হবে। তুমি মাটির মানুষ। এ মানুষকে বড্ড ভালোবাসি।আমি আবারো আসবো ।তোমার সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে । তোমার সাথে জ্যোৎস্নাস্নান করতে। তুমি অপেক্ষা করবে তো?

- রোদেলা

চিঠিতে আর কিছু লেখা নেই। সূর্যের প্রচন্ড তাপ । গাঁ পুড়ে যাচ্ছে। সমস্ত শরীর কাঁপছে কাশেমের ।

পুরো বাগান বাড়িতে একজন মানুষ । আবার সবাই ফিরবে তাদের আপন ঠিকানায়। কিন্তু কাশেম যার জন্য অপেক্ষা করছে সে কি ফিরবে? হয়তো ফিরবে , হয়তো ফিরবে না।

 

~রুহুল আমিন

Tags:

About author
আমি গল্প এবং বই প্রেমিক একজন মানুষ। গল্প এবং বই পড়তে খুবই ভালোবাসি। যেখানেই যে গল্প অথবা কাহিনী খুজে পাই সেগুলো সংগ্রহ করি এবং আপনাদের সাথে শেয়ার করার চেষ্টা করি। আমি নিজেও কয়েকটি গল্প লিখেছি তবে সেগুলোর সংখ্যাটা খুবই সামান্য।