অফিসের বদলির কারণে একটা সবুজ অরণ্য ঘেরা বন-জঙ্গলের মধ্যে একটা কোয়াটারে থাকার ব্যবস্থা হলো।প্রথমে ভেবেছি শহরের মতো সুযোগ সুবিধা তো পাবো না। এখানে যাতায়াতের অসুবিধা হবে।নিজেকে অন্য রকম নির্জন পরিবেশে মানিয়ে নিতে বেশ কষ্টসাধ্য হবে। এ বিষয় গুলো নিয়েই বেশ গিল্টি ফীল করেছি।
বন-জঙ্গলের অন্য রকম শব্দ আছে।সেই সাথে বিভিন্ন রকমের নাম জানা না জানা পোকা-মাকড়ের ডাক।মাঝে মাঝে শেয়াল,বন শুয়োর এর ডাক ভেঁসে আসছে।ভেবেছি এত শব্দে ঘুম মোটেও আসবে না। আমার থাকার রুমটা ভ্যাবশা গরমে ছেঁয়ে আছে। জানালা টা খুলে দিতেই এক ঝাক ঠান্ডা বাতাস মূহুর্তেই আমার শরীর শীতল করে দিলো।উপভোগ করার মতো। জন্তুজানোয়ারের ভয়ে জানালা লাগিয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলাম।সল্প সময়ের মধ্যেই ঘুমিয়ে গেলাম।অন্য সময় আমার ঘুমোতে বেশ দেরি হয় বললেই চলে।
প্রথম দিন ভোর রাতেই ঘুম ভেঙে গেলো পাখির কিচিরমিচির আওয়াজে।কিছুটা বিরক্তিকর ভাব আসে আমার মাঝে।অন্য দিন অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমোনোর অভ্যাস আমার। বিছানাই চোখ বন্ধ করেই শুয়ে রইলাম এই আশায় যেনো আর একটু ঘুমোতে পারি।তা আর হলো না।গতকালকে রান্নাবান্নার সব সরঞ্জাম নিয়ে এসেছি।হিটারে চা করে বারান্দায় গিয়ে বসলাম। আবাছা অন্ধকার একটু একটু করে কেটে যাচ্ছে। দিনের আলোরা ভিড় জমানোর চেষ্টা করছে।এর থেকে সুন্দর দৃশ্য আগে কখনো দেখার সুযোগ হয়নি।শহরে এখন গরমকাল চলছে।কিন্তু এখানে এই মূহুর্তে ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে ক্ষাণিক। পাখিরা খাবারের সন্ধানে এদিক ওদিক ঘুরে ফিরছে।আগের অসহ্য ভাবটা কেটে গেছে। বেশ বেলা পর্যন্ত বসে বসে প্রকৃতির লীলাখেলা দেখলাম।
সকাল দশটা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত অফিস।গতকালকে পরিচিত হয়েছি সজিব ভাইয়ের সাথে।ওনি আমার কলিগ। এতক্ষণে বুঝেছি ওনি বেশ মিশুক একটা লোক।বিকেলে ওনার সাথে বেড় হলাম চারপাশ ঘুরে দেখতে।আমাকে এই গাছ ও গাছ দেখিয়ে গাছের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। ওনার সাথে ওখানকার বাজারে গেলাম।মাত্র গুটি কয়েকটা দোকান। আর বাকি সবাই রাস্তার ধারে মাচায় বসে টং দোকানের মতো দোকান থেকে তরি-তরকারি বিক্রি করছে।সব কিছুই টাটকা আর ফলমালিন মুক্ত।আমাদের শহরে তো কোন কিছুই টাটকা পাওয়া যায় না। সজিব ভাই মাত্র ৫টাকা দিয়ে বেশ বড় সাইজেই দুইটা পেয়ারা কিনলেন।আমি এই প্রথম সামনাসামনি এত বড় পেয়ারা দেখলাম।
আগের দিনের ন্যায় পরদিন ও একই সময়ে ঘুম ভাঙলো। সজিব ভাই আমাকে ডেকে সাথে নিয়ে মসজিদে গেলেন নামাজ পড়ার জন্য । প্রায় ৫/৭মিনিটের পথ।মসজিদ টা মুলত বাঁশ দিয়েই তৈরি। অজু করতে পুকুর ঘাটে গেলাম।পুকুর পাড়ে গাছের ডুম আকৃতি দিয়ে ঘাট বানানো। পানিটা ঠান্ডাও না। না গরম। নামাজ পড়ে আসার পথে ভাই মিনিমাম ৪ফিটের একটা গাছ থেকে ঘুঘু পাখির দুটো বাচ্চা সাথে নিয়ে আসলেন। সন্ধায় ভাই আমাকে নিমন্ত্রণ করলো ওনার সাথে ডিনার করার জন্য।যাওয়ার পর সকালের আনা ঘুঘু পাখি রান্না করা তরকারি দিলেন।আমি সংকোচ বোধ করছি দেখে ভাই বলল এটা নাকি একেবারে কবুতরের বাচ্চার মতো।টেস্ট করলাম আসলেই দারুণ।
অফিস ছুটির দিনে সন্ধা বেলা মায়ের সাথে কথা বলছি কোয়াটারের সামনে ঘাসের উপর বসে। বিড়ালের আওয়াজ শুনতে পেয়ে ঝোপের দিকে গেলাম। একটা বাচ্চা বিড়াল।খুব ছোট। ঝোপের মাঝে আটকা পড়ে আছে।এদিক সেদিক যেতে পারছে না।রুমে এনে বেশ আদর যত্ন করলাম। সারাক্ষণ রুমেই পড়ে থাকে।ভদ্র বলা চলে।
সেদিন আমার পিছনে পিছনে বাইরে বের হলো।একটা কুকুর দেখতে পেয়েই ভোঁ দৌড়ে রুমে গিয়ে আলনার নিচে গিয়ে লুকালো।আমি যা ইশারা করি তাই যেনো বোঝে।সজিব ভাই ও বেশ আদর করে বিড়াল টার।বিড়াল টার নাম দিয়েছি 'রক'। সজিব ভাই আমি এমন নাম রেখেছি শুনে হাসতে হাসতে খুন হবার জোগার।সময় অতিবাহিত হয় আর আস্তে আস্তে রক বড় হয়।তাও রুম থেকে বিন্দু পরিমাণ বের হয় না। সেবার রোজার ঈদ টাও সেখানেই কাটাই।বাড়ির সবাই বলে বাড়িতে যেতে।কিন্তু এখন আর মন টানে না। এখানে কিছু মানুষ অধিক প্রিয় হয়ে গেছে।তাদের সাথে খুব সখ্যতা গড়ে উঠেছে।
বেশ কিছুদিন পরে একদিন অফিস থেকে ফিরে দেখি রক কোনায় গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে।অন্য দিন আমি আসলেই আমার কাছে এসে আমার শরীরে গা ঘসে। আমার চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু সেদিন ব্যতিক্রম।
ডাকার পরেও আসলো না। কাছে গিয়ে শরীরে হাত দিয়ে দেখি শরীর প্রচন্ড গরম।একটু দূরে একটা আধ খাওয়া ইদুর পরে আছে। তাৎক্ষনিক কয়েকটা জ্বরের ট্যাবলেট খায়িয়ে দিয়ে নিজেও ডিনার শেষ করে বিড়ালের পাশে চুপ করে অনেকক্ষণ বসে থাকলাম।চোখে ঘুম আসার কারণে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ি।
সকালে ঘুম থেকে উঠে বিড়ালের কাছে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে কতক্ষণ বসেছি খেয়াল নেই।বিড়াল টা মরে শক্ত হয়ে আছে। অনেকক্ষণ আগেই মরেছে তা বেশ বুঝতে পারছি।দরজায় সজিব ভাইয়ের টোকা শুনে ঘোর কেটেছে। ভাইকে সব বললাম। ওনি আমাকে শান্তনা দিয়ে বলল ওনার রুমে ইদুরে উতপাতের কারণে দুইদিন আগে ইদুর মারার বিষ এনে ওনার রুমে রেখেছে যেনো ইদুর খেয়ে মরে যায়। বুঝতে পারলাম ইদুর বিষ খাওয়ার ফলে মরা যায়।আর সেই ইদুর বিড়াল খাওয়ার ফলে সেও মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে। রক এর মৃত্যুতে আমাকে বেশ বেগ পোহাতে হয়েছে। নাওয়া-খাওয়া কমে গিয়েছিলো।মনে পড়লেই বুক ভর্তি একটা বেদনার বাতাস বের হয়েছে।এখনো হয়।
লিখা:-R.Md Rakib
Comments (0)