বৈশাখ মাস।মাঠে চকচকে হলুদ পাঁকা ধান।ধানের গন্ধে চারিদিক মঁ মঁ করছে।কেউ কাটছে,কেউ আনছে,কেউবা সিদ্ধ করে রোদে শুকাচ্ছে।মোদ্দাকথা ফসল ঘরে তুলতে ব্যস্ত সবাই।ধম ফালানোর সময় নেই।আমার এক চাচা বলতেন,কাজের দিনে তিনি দিনের বেলায় বাথরুম করতেন না,রাতে করতেন।দিনের বেলায় কাজ ফেলে বাথরুমে বসে থাকা যায় না।রাতে কোন কাজ থাকে না,আরামছে বাথরুম করা যায়।'
মজিদ মিয়া এসেছে তাঁর ধান পেঁকেছে কি-না দেখতে।ক্ষেতের কাছে এসে তাঁর মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল।মজিদ মিয়ার ধান তেমন একটা ভালো হয়নি।চৈত্র মাসের শেষের ঝড় বৃষ্টিতে ধানের অনেকখানি ক্ষতি হয়েছে।কম বেশ সবারই ক্ষতি হয়েছে তবে মজিদ মিয়ার ধানে ক্ষতির প্রভাবটা একটু বেশিই পড়েছে বলে মনে হয়।তাঁর ধানের অবস্থা এমনিতেই কাহিল ছিলো।লাগানোর পর থেকে ঠিকমতো যত্নআদি করতে পারেন নি।সময় মতো স্যার পানি দিতে পারেন নি।তারপর আবার অসময়ে ঝড় বৃষ্টি।এতোকিছুর পরও যে,তাঁর ক্ষেতে ধান দেখা যাচ্ছে একমাত্র আল্লাহর অশেষ কৃপায়।এই দিক থেকে মজিদ মিয়া আবার বেশ খুশি। সে খুশি মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছে।মজিদ মিয়া ভেবে চিন্তে ঠিক করে ফেললো,কালই লোক দিয়ে ধান কাটিয়ে ফেলবেন।'
পরেরদিন ফজরের নামাজ পড়ে ভোর সকালে মজিদ মিয়া বাজারে আসলেন।কামলার বাজার বেশ চড়া।গতকালও ৩০০ টাকা রোজে অহরহ লোক পাওয়া যেত।আর আজকে ৪০০ টাকা দিয়েও লোক পাওয়া যাচ্ছে না।গেরস্তরা ব্যস্ত হয়ে লোক খুঁজছে।অবশেষে মজিদ মিয়া ৪০০ টাকা করেই চারজন লোক নিলেন।কী আর করবেন, ধান তো কাটাতে হবে!
বৈশাখ মাসের দিনের কোন ঠিক ঠিকানা নাই।এই বৃষ্টি এই রোদ।বৃষ্টি রোদে বিচ্ছিরি অবস্থা।ধান ঘরে তোলা না পর্যন্ত গেরস্তের মনে শান্তি মিলে না।'
মজিদ মিয়া লোকেদের সকালের নাস্তা খাইয়ে ক্ষেতে নিয়ে এসে ধান কাটতে লাগালেন।তারপর তিনি আবার বাজারে আসলেন।তিনি বড় দেখে একটা মুরগি কিনলেন,লোকেদের খাওয়ানোর জন্য।এরা গরীব মানুষ কী খায় কে জানে!তা ছাড়া বছরে তো একবারই আসে একটু ভালো কিছু খাওয়াতে হয়। এতে কামলাদের মন খুশি থাকে।অন্য কেউ হলে এসব নিয়ে ভাবতো না।কামলাদের আবার খুশি-অখুশি।একটা দিয়ে খাওয়ালেই হয়।এদের বেশি খাওয়ালে কাজ কম করে আর কম খাওয়ালে বেশি।মজিদ মিয়া এমন না।না খেলে কাজ করবে কীভাবে?তা ছাড়া তাঁর বাড়িতে একটা ভিক্ষুক আসলেও তিনি না খাইয়ে ছাড়েন না।অচেনা মানুষকেও অতিথির মতো আপ্যায়ন করেন।এটা তাদের বংশের রিতি।'
মজিদ মিয়ার ছোট সংসার। এক ছেলে আর এক মেয়ে।গত বছর মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন আর ছেলেটা এবার ক্লাস সেভেনে পড়ে। এ ছাড়াও তাদের সংসারে নতুন দুজন সদস্য যোগ হয়েছে।মজিদ মিয়ার ছোট বোন আর তাঁর মেয়ে।মজিদ মিয়ার ছোট বোনটা বড় অভাগা কপাল নিয়ে জন্মেছে।জন্মের পরই বাবাকে হারিয়েছে তার কয়েক বছর পর মা'কে আর এখন বিয়ের পর পরই জামাইকে হারিয়েছে।একের পর এক স্বজন হারানোর ব্যথা সইতে সইতেই তাঁর জনম কেটেছে।'
স্বামী সংসার হারিয়ে বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে অবশেষে ভাইয়ের সংসারে ঠায় হয়েছে।এ ছাড়া আর যাবেই বা কোথাও?মজিদ মিয়াও তাদের আপন করে নিয়েছে।বোন ভাগ্নির সব রকম দেখাশুনা দায় দায়িত্ব নিজের কাঁদে তুলে নিয়েছে।সে ছাড়া আর কেই বা আছে?তারপরও এ সংসারে কেই বা চায় বাড়তি ঝামেলা পোহাতে?কে কার জন্য এতোটুকু করে?তবে মজিদ মিয়া তাঁর বোনের জন্য সব সময় করে এসেছে,এখনও করছে।বাবার পত্রিক সম্পত্তি থেকে বোনের যা পাওনা ছিলো পাই পাই করে বুঝিয়ে দিয়েছে।তাদের সব রকম সুযোগ সুবিধা করে দিয়েছে।ভবিষ্যতে আরো করবেন।বোনের এতিম মেয়েটাকে দেখে তাঁর বড় মায়া লাগে।মজিদ মিয়া ভাবে,এই মেয়েটার জন্য সে সবকিছু করতে পারবে।'
লোক চারজনকে মজিদ মিয়ার খুব পছন্দ।কথাবার্তা,কাজে কর্মে সবদিক থেকেই ভালো।তারা নিজের মতো করে কাজ করছে।গত বছর যে লোকগুলো এনেছিলো তাদের মতো ফাঁকিবাজি করছে না।গত বছরের লোকগুলো ভীষণ ফাঁকিবাজ ছিলো।দশ মিনিট কাজ করলে পাঁচ মিনিট বসে কাটাতো।কিছু বললে বলতো,চাচা বিড়ি খাইতেছি।বিড়িটা শেষ করেই কাজে লাগবো।মজিদ মিয়া ভেবে পায় না,বিড়ির মধ্যে কী এমন আছে যে একটু পরপর খেতে হবে!'
মজিদ মিয়ার ধারণা ছিলো,একটু আগেভাগেই ধানকাটা শেষ হয়ে যাবে।তাঁর জমি বেশি না,মাত্র (৪০ শতাং) চার কাটা।তা ছাড়া তাঁর জমিতে ধানও কম হয়েছে।আর কামলারাও কাটছে মনোযোগ দিয়ে।কিন্তু দুপুরবেলা হঠাৎ করে বৃষ্টি নামাতে কাজে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটেছে।তবে এই ফাঁকে তিনি লোকেদের খাবার দাবারও শেষ করে নিয়েছেন।মজিদ মিয়ার আপ্যায়নে তারা খুবই খুশি হয়েছে।তাদের নির্ধারিত সময় অতিবাহিত করেও বাড়তি কিছুটা সময় মজিদ মিয়াকে কাজ করে দিয়েছে।মজিদ মিয়া বড়ই খুশি হয়েছে।তাদেরকে চা-নাস্তা খাওয়ার জন্য এক'শ টাকা বকশিস দিয়েছে।'
অন্য কেউ হলে এটা করতো না।বকশিস তো দূরের কথা উচিত টাকায় দিতে চায় না।আজ নয় কাল,কাল নয় পরশু এভাবে কামলারের ঘুরায়।অনেকে তো আবার টাকা দিবে না বলে,সরাসরি না করে দেয়।এমন মানুষ তাদের এলাকাতেও কিছু আছে।'
প্রায় বিশ মন ধান হয়েছে মজিদ মিয়ার জমিতে।যার বর্তমান বাজার মূল্য ৫২০ টাকা ধরে '১০৪০০'টাকা।মজিদ মিয়া একটু হিসাব করতে চেষ্টা করলেন।এ পর্যন্ত জমি লাগানো, কাটানো, স্যার,ঔষধ, পানি,চাষ সহ যাবতীয় খরচা হয়েছে প্রায় '৯০০০' টাকা।নিজে যে দেখাশুনা যত্নআদি করেছেন এসব বাদই দিলেন।তারপরও হিসাব মিলাতে পারছেন না।আসলে ধান চাষ করে তেমন একটা লাভ হয় না।লাভের মধ্যে লাভ এতটুকুই ঘরের ভাত খাওয়া যায়।দু'দিন পর পর চাল কেনার জন্য পেরেশানি করতে হয় না।'
মজিদ মিয়া ভাবে,এই সিজনে ধান কম হয়েছে আগামী সিজন হয়তো বেশি হবে।শুধু এই স্বপ্ন বুকে জড়িয়ে প্রতিটা কৃষক প্রতিদিন রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে সোনা ফসল ফলায়।তাদের বিশ্বাস আছে,আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'য়ালা কাউকে নিরাশ করেন না।এবার হয়নি পরের বার হবে।আল্লাহ চাইলেই হবে।তার কাছে কোনোকিছুর অভাব নেই।'
-- সমাপ্ত
লেখাঃ আলম সরকার ধ্রুব
Comments (0)