ঝগড়ার এক পর্যায়ে ভাবী ভাইয়াকে বললো,
--বাবার বয়স হয়েছে।আমি আর তুমি সারাদিন জব করি।বাবার খেয়াল রাখার মতো কেউ নেই।ওনাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিলে সেখানে ওনার ভালোই লাগবে।একা থাকা লাগবে না ওনার।আর আমি শুনেছি আজকাল বৃদ্ধাশ্রমে নাকি অনেক দেখাশুনা করে ঐখানের লোকজন।
ভাবির মুখে এই কথা শুনে কিছুসময়ের জন্য হতভম্ব হয়ে গেলাম।ভাইয়া প্রতিউত্তরে কিছু বলছেনা।আমি দাঁড়িয়ে আছি ওনাদের সামনে।তবুও প্রতিবাদ করতে পারছিনা।ভাবি আবার বলে উঠলো,
--কিছু বলছো না যে।
ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
--অভ্র তুই তোর রুমে যা এখন।
আমি ভাইয়ার কথার অবাধ্য কোনোদিন হয় নি।ভাইয়া চলে যেতে বলার সাথে সাথেই চলে আসলাম রুমে।ভাইয়া ভাবির কথার প্রতিউত্তরে কি বললো শুনতে পারিনি।ভাইয়া আর ভাবির ভালোবেসে বিয়ে।দুজনেই একই কোম্পানিতে জব করে।সেই সূত্রে পরিচয়।তারপর প্রেম আর বিয়ে।খুবই ভালো চলছিলো সব।কিন্তু ছয় মাস যেতে না যেতেই ভাবির মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করতে লাগলাম।ভাবি কেনো জানি আমার আর আব্বার উপর অনেক বিরক্ত হয়ে উঠেছেন।মাঝে মাঝে আমাকে আর বাবাকে কিছু কটু কথাও শুনিয়ে দেন।আমার পড়ালেখার খরচের অর্ধেকটা চালায় ভাইয়া।বাকি অর্ধেক আমি টিউশন করে চালিয়ে নিই।বাবা সারাদিন বাসায় থাকে।ভাবি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে তা আমি চুপ করে সহ্য করে নিই।কিন্তু বাবাকেও তিনি ছাড়েন না।ভাইয়াকে কোনোদিন বলিনি ভাবির সম্পর্কে।আমি বলেই দিতাম।আব্বা কথা নিয়েছেন না বলার জন্য তাই বলিনা।ভাইয়া খেতে ডাকলো।খাবার টেবিলে এসে দেখি ভাবির মুখে রাজ্য জয় হাসি।তাহলে কি ভাইয়া ভাবির প্রস্তাব মেনে নিয়েছে?খাওয়া শুরু করার পর ভাইয়া বাবার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
--আব্বা এইখানে থাকতে তো আপনার অনেক কষ্ট হচ্ছে তাই না।সারাদিন আমি আর অবনী তো অফিসে থাকি।অভ্র থাকে হোস্টেলে।তোমার একা ঘরে থাকতে অসুবিধা হয়।এইজন্যে আবনী সিদ্ধান্ত নিয়েছে তোমাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসতে।আমিও তার সিদ্ধান্তকে ঠিক মনে করেছি।এক সপ্তাহের মধ্যে কাগজপত্র সব রেডি করে নিবো।তুমি তৈরি থেকো।
আমি কিছু বলতে যাবো তার আগে আব্বা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
--আচ্ছা।তুই যাই বলবি তাই করবো।
এই কথাটা বলে আব্বু চুপচাপ খেতে লাগলো।ইশারায় আমাকেও খেতে বললো।রাগে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে।তাহলে ভাইয়াও ভাবির কথা মেনে নিলো।এই সেই আবির ভাইয়া যে কিনা বাবাকে ছাড়া এক মূহুর্তও কাটাতে পারতো না।বাবার জন্য যে বাইরে পড়ার সুযোগ পেয়েও যেতে রাজী হয় নি।সেই ভাই কিনা বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিবে বলছে।।খাওয়া শেষে আমি আব্বুর রুমে গেলাম।আব্বু আমাকে দেখে চোখের জল লুকানোর অনেক চেষ্টা করলো।কিন্তু তিনি ব্যর্থ হলেন।আমি আব্বুকে বললাম,
--আব্বু তুমি ভাইয়ার কথায় রাজি হয়ে গেলে কেনো??
--আরে পাগল তোর ভাইয়া তো আমার ভালোই চাই।
-তোমাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো টা কি রকমের ভালো একটু বুঝিয়ে বলবে আমায়??
--আরে তুই ছোট মানুষ বুঝবিনা।
--আব্বু আমি অনার্সে পড়া ছাত্র।এতটাই অবুঝ না।আমি এক্ষুনি ভাইয়াকে গিয়ে ভাবির সব কথা বলবো।এসব কিছুর পিছনে ভাবির হাত।
-অভ্র চুপ কর।আমাকে দেওয়া কথা ভুলে গেলি এতো তাড়াতাড়ি।
--না আব্বু ভুলিনি।কিন্তু ভাইয়া যেটা করতে চলেছে এইটা ভুল।
--ভুল নাকি ঠিক সেটা আমি বুঝবো।তুই যা এখন।
আব্বু উল্টো দিকে ঘুরে গেলো।আমি জানি আব্বু এখন কান্না করছে।আমিও কিছু না বলে রুমে চলে আসলাম।ভাইয়ার উপর খুব রাগ হচ্ছে।ভাইয়া কিভাবে এমনটা করতে পারে??আমার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে।সিদ্ধান্ত নিলাম এই সাতদিনের মধ্যে কিছু না কিছু ব্যবস্থা করতে হবে।বাবাকে আমি বৃদ্ধাশ্রমে যেতে দিবো না।জীবনেও না।
দেখতে দেখতে ছয়দিন কেটে গেলো।আমি আর আব্বু বসে আছি।ভাইয়া এসে বললো,
--আব্বু কালকে সকালে তৈরি থেকো।তোমাকে সাথে করে নিয়ে যাবো।
--আচ্ছা বাবা।
এই বলে ভাইয়া চলে গেলো।ভাইয়া যাওয়ার সাথে সাথে আব্বু কান্না করতে লাগলো।আমি আব্বুকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
--আব্বু আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।তুমি কিছু চিন্তা করিও না।
আব্বু কেদেই চলেছে।এই কয়েকদিনে ভাবির মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি।ভাবি আব্বুর অনেক যত্ন করছে।রাতে আব্বু আর আমি না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছি।সকালে আব্বু ব্যাগপত্র নিয়ে বের হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আমিও আছি পাশে।ভাইয়া বলেছে আব্বুকে নাকি বৃদ্ধাশ্রমে রেখে সে আর ভাবি ঘুরতে যাবে।ভাইয়ার দিকে তাকাতেও ইচ্ছে করছে না।প্রচন্ডরকমের ঘৃণা করি তাকে এখন।বাসা থেকে বের হতে যাবো ঠিক তার আগ মূহুর্তে ভাইয়া থেমে গেলো।ভাইয়া আব্বুকে বললো,
--আব্বু মনে আছে আমার বয়স যখন দশ তখন আম্মা মারা যায়।তারপর থেকে তুমি আমাকে আর অভ্রকে মার ভালোবাসা কি বুঝতে দাও নি?শুধু যে বাবার দ্বায়িত্ব না।তুমি মার দায়িত্ব আর অভাবটাও পূরণ করেছো।সেই মানুষটাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো কিভাবে?
ভাইয়া কাগজগুলো বের করলো।কাগজগুলো ভাবির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
--আমার সাতদিন সময় লেগেছে এইগুলো তৈরি করতে।এইখানে ডিভোর্স পেপার আর তোমার কাবিনের নির্ধারিত টাকার চেক আছে।আমি সাইন করে দিয়েছি।তুমিও ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিও।যে মেয়ে আমার বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার কথা বলে সে আমার জীবনে থাকার অধিকার রাখে না।তুমি জানো আমার রাগ কেমন??গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে সোজা তোমার বাসায় চলে যাও।আমি তোমার বাসায় কল করে জানিয়ে দিয়েছি।আজকের পর থেকে আমার জীবনে তোমার কোনো অস্তিত্ব নেই।
ভাবি ঠাই দাঁড়িয়ে আছে।আমি হতভম্ব।আব্বুর চোখে জল।তিনিও কিছু বুঝতে পারছেন না।ভাইয়া আব্বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,
--এই কয়েকটাদিন তোমাকে অনেক কষ্ট দিছি।আমার পাগল ভাইটা আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছে।আব্বা আমাকে মাফ করে দিও?
আব্বু কিছু না বলে কেদেই চলছে।আমি দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে চোখের জল ফেলছি।ভাইয়া ইশারায় আমাকে ডেকে নিলো তার কাছে আমাকেও আব্বুর সাথে জড়িয়ে ধরলো।ভাইয়া,আমি আর আব্বু এখন পার্কের একটা বেঞ্চিতে বসে বাদাম খাচ্ছি।বাদাম খেতে খেতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছি।সামনে দেখি এক লোক তার দুই সন্তানকে নিয়ে খেলছেন।ঠিক এইভাবেই ছোটবেলায় আব্বু আমাদেএ সাথে খেলতেন।আমি এক ফাঁকে আব্বু আর ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছি।তারা দুজনে আবাক নয়নে সেইদিকে তাকিয়ে আছে।আব্বু ভাইয়াকে বললো,
--সত্যি সত্যি কি বউমাকে ছেড়ে দিবি?
--না আব্বা ছাড়বো না।কিন্তু তাকে তার ভুল বুঝতে হবে।ততদিন পর্যন্ত সে তার বাসায় থাকুক।তার মা-বাবাকে সবকিছু আগে থেকেই বলে রেখেছি।
আব্বু কাদছে।ভাইয়াও কাদছে।আর আমি তাদের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।এই মূহুর্তে এই চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর হতে পারে বলে মনে হয় না আমার।
------সমাপ্ত-------
মোঃ জীবন রহমান
Comments (0)