আমি শফিক আলম, বয়স ২১ বছর । বসে আছি থানার হাজত খানায় । আমি এখনো জানি না আমাকে কেন এখানে আটকে রাখা হয়েছে । আমার ফোন, মানিব্যাগ সব কিছু জব্দ করেছেন পুলিশ অফিসার । সন্ধ্যায় মতি মামার দোকানের পিছন দিকে বসে চা-সিগারেট খাচ্ছিলাম । এই দোকানেই বেশি আড্ডা দিই আমি । প্রতিদিনের মতো আজকেও সেখানে বসে ছিলাম । আমার সাথে ছিল রাকিব এবং আসলাম । দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে বিজ্ঞ মানুষের মতো একটু আলোচনা করছিলাম । তখন সেখানে হাজির হলো তিনজন পুলিশ কর্মকর্তা । তাদের মধ্যে একজন কর্তৃত্ব মাখা গম্ভীরস্বরে মতি মামাকে জিজ্ঞেস করলেন,
-শফিক আলমের বাসা কোনটা?
-কোন শফিক আলম? জিজ্ঞেস করলেন মতি মামা ।
-পিতার নাম করিম উদ্দিন ।
-কেন কি হয়েছে? মতি মামা উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন ।
-তেমন কিছু না । শফিক আলম একটি লটারি জিতেছে । এজন্য আমরা তাকে অভিনন্দন জানাতে এসেছি । আমাদেরকে একটু শফিক আলমের বাসায় নিয়ে চলেন ।
লটারির কথা শুনে মতি মামার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো । মুখ থেকে চিন্তার ছাপ দূর হয় গেল । তিনি পুলিশ কর্মকর্তাকে বললেন,
- শফিক দোকানের পিছন দিকে আছে দেখেন ।
-ধন্যবাদ ।
পুলিশের তিন কর্মকর্তা আমাদের দিকে এগিয়ে আসলেন এবং তাদের মধ্যে সেই গম্ভীর স্বরের লোকটা জিজ্ঞেস করলেন,
-আপনাদের মধ্যে শফিক আলম কে?
আমি বললাম, আমি । কেন কি হয়েছে?
- আপনি আমাদের সাথে চলুন, দরকার আছে ।
আমাকে থানায় নিয়ে এসে আটকিয়ে রাখা হলো । আধা ঘন্টা পরে সেই গম্ভীর স্বরের লোকটি আসলেন আমার কাছে । জিজ্ঞেস করলেন,
-খুনের সময় তোর সাথে আর কে কে ছিল নাম বল?
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম । আমি বললাম, সরি স্যার । আমি আপনার কথা কিছুই বুঝছি না । কিসের খুনের কথা বলছেন?
তিনি আমার ডান গালে ঠাটিয়ে একটি চড় মেরে বললেন, অভিনয় করস শালারপুত! তাড়াতাড়ি বল তোর সহযোগী কে কে ছিল?
চড় খেয়ে বুঝতে পারলাম লোকটা বাঁ-হাতি । এতো জোরে চড় আমি কখনো খাইনি । চড়টা মনে হলো মস্তিষ্কে গিয়ে আঘাত করলো । আমার চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গেল । নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বললাম,
- সত্যি স্যার, আমি আপনার কথা কিছু বুঝছি না । আমি কোনো খুন করিনি । আপনার মনে হয় কোনো ভুল হচ্ছে ।
তিনি আমার কথায় কান না দিয়ে বললেন,
- রনিকে কেন খুন করলি?
-স্যার, আমি কোনো খুন করিনি ।
-ভালোই ভলোই স্বীকার করবি নাকি রিমান্ডে নিতে হবে?
- স্যার, আমার অপরাধ কি? আপনারা কেন আমাকে ধরে আনলেন?
- তুই রনির খুন করেছিস ।
- সত্যি স্যার আমি কোনো খুন করিনি ।
- তাহলে ভিকটিমের মোবাইল ফোন তোর কাছে পাওয়া গেল কেন?
এইবার সম্পূর্ণ ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হলো । আমি দুইদিন আগে অনলাইন থেকে যেই সেকেন্ড হ্যান্ড মোবাইল ফোনটা কিনেছি সেটা তাহলে এই রনির ফোন ছিল । আমি বললাম,
-স্যার, আমি দুইদিন আগেই ফোনটা অনলাইন থেকে কিনেছি । আমি যদি জানতাম এটা খুন হওয়ার ব্যক্তির ফোন তাহলে আমি আমি কিনতাম না ।
- সেটা বললে তো হবে না । ভিকটিমের ফোন তোর কাছে পাওয়া গিয়েছে এখন তোর বিরুদ্ধে খুনের মামলা হবে ।
আমার গলা শুকিয়ে গেল আমি তার পায়ে ধরে বললাম, প্লিজ স্যার আমার বিরুদ্ধে কোনো মামলা দিবেন না । আল্লাহ্র কসম স্যার আমি সত্যিই এই ব্যাপারে কিছুই জানি না । আমি স্টুডেন্ট স্যার । আমার লাইফটা নষ্ট হয়ে যাবে ।
তিনি কিছু না বলে চলে গেলেন । আমার মাথা ঘুরছে । ঘামে শরীরের পোশাক ভিজে গিয়েছে । কোনো ফ্যান নেই সেখানে । প্রচুর অস্বস্তি লাগছে । আমার জীবনে এরকম পরিস্থিতি আসবে কখনো সেটা ভাবতে পারিনি । টিউশনি করে ছয়মাস ধরে কিছু কিছু টাকা জমিয়ে শখের একটি মোবাইল ফোন কেনা-ই আমার কাল হলো । নিজের ভাগ্যকে গালি দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই আমার । মনে মনে খুনিকে প্রচুর অভিশাপ দিতে থাকলাম ।
ঘন্টাখানেক পরে বাবা-মা আর ছোট ভাই আমার সাথে দেখা করতে আসলেন । তাদের দেখে মনটা একটু শান্ত হলো । মা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন । মায়ের কান্না দেখে আমারও কান্না এসে পড়লো । বাবা-মা আমাকে অভয় দিলেন কোনো চিন্তা নেই । তাড়াতাড়ি আমাকে বের করবেন । আমি আশ্বস্ত হলাম । বাবা-মায়ের মন আমার থেকেও বেশি খারাপ হয়ে আছে দেখলাম । কিন্তু ছোট হাসিবকে দেখে মনে হলো সে একটু খুশিই হয়েছে । হাসিব ক্লাস ফোরে পড়ে । সুযোগ পেলেই আমার কম্পিউটারে গেইম খেলে । কিন্তু আমি খেলতে দিইনা । এখন সে সারাদিন কম্পিউটারের গেইম খেললে কেউ বাঁধা দিবে না ভেবে সে কিছুটা খুশি । হাসিব আমাকে বললো, ভাইয়া তোমাকে বের করার জন্য আমি কেডি পাঠককে নিয়ে আসবো ।
আমি বললাম, কেডি পাঠকে আনতে হবে না । তুই ঠিক মতো পড়ালেখা করিস । আর গেইম খেলবি না ।
হাসিব মুখ ভেংচি দিয়ে বললো, এখন থেকে কম্পিউটার আমার ।
পরের দিন প্রিজন ভ্যানে আমাকে আদালতে পাঠানো হলো । আদালতের হাজত খানায় আমাকে আটকে রাখা হলো । কয়েকঘন্টা পরে আমাকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে নেওয়া হলো । তিনি আমাকে জেল হাজতে রেখে তদন্ত করার নির্দেশ দিলেন ।
সেইদিন বিকালে আমাকে জেলা করাগারে পাঠানো হলো । নানা রকমের অপরাধীর ভিড়ে নিজেকে খুঁজে পেয়ে একটাই কথা মাথায় আসলো, আমি যদি মোবাইল কেনার ব্যাপারে একটু সচেতন থাকতাম তাহলে আজ এখানে থাকতাম না ।
অংকুর রায় অনিক
Comments (0)