কাগজটা হাতে নিয়ে বসে আছে সুরমা। কাগজটায় নতুন কিছু নেই। জানা কথা। আজ নিশ্চিত হওয়া গেলো।সকালে নাস্তার সময়ও মনে হয়েছে- এমন ঝগড়াঝাটি কোন সংসারে হয় না! সহ্যতো কম করলোনা জীবনে সুরমা।
তবে সুরমা মামুনের উপরে শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস ছিলো। এর আগে এই বাজে কথাটা কতবার বলেছে।তাই অতটা গায়েই তোলেনি সুরমা।
এবার মন দোটানায় ছিলো। একমাত্র পুত্র সে ও বাবার পক্ষ নিয়ে কথা শোনাতে ছাড়েনি।
ভয়টা সেখানে ছিলো!
হাতে ধরা কাগজটা খুব বেশি প্রভাব ফেলেনি সুরমা মনের উপর।
একটা ভাবনাতেই আবদ্ধ সে।
মেয়ে তিনটের ভালো বিয়ে দিয়েছে।পড়াশুনায় বা চেহার সুরতে আর্কষণীয় ছিলো তিন মেয়ে।
দুটো মেয়ের পর একটা ছেলে হলো। ছেলের মুখ দেখে সুরমা কিছুটা আসস্থ হয়েছিলো। সত্যি সুরমার জীবন চিত্র পাল্টে গেলো। বোনদেরও নয়নমনি ভাই।মশিউর রহমন বাবু।
মা'অন্ত প্রাণ। সে সাতসকালে বেরিয়ে যেত সুরমা।তিনটে বাড়ির বাচ্চাদের আরবী শিক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরতো। ঘুম ভেঙ্গে মা' কে কাছে না পেলে কেঁদে বুক ভাসাতো বাবু।
বোনেরা সামাল দিতো। মামুন তখন সুতো কারখানায় কাজ করে।
সুরমার পূর্বপরুষরা পশ্চিম বঙ্গের মেদিনী পুরের বাসিন্দা। মামুনের দাদা সাতচল্লিশের পরপরই গেন্ডারিয়া বসতি গড়েন।
সুরমা নারায়নগঞ্জের মেয়ে। মেধাবী। কিন্তু দরিদ্র। ম্যাট্রিক পাশ করেছে সফলতার সাথে।
মেয়ে দুবেলা খেয়ে পরে ভালো থাকবে এই আশায় মামুনের সাথে বিয়ে দিলেন সুরমার বাবা।
বত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবন।
বিয়ের পরের বছর সুরমা- মামুনকে সংসারের অভাব অনটনের কথা বলে টিউশনি করতে চাইলো।
বাচ্চা কাচ্চা হলে আর খরচ বাড়বে।
স্বামীর রোজগারের সাথে বাড়তি কিছু উপার্জনে আশায় সকালে বিকালে বেশ কয়েকটা টিউশন নিয়েছিলো।
মামুনের টাকায় সংসার কোন রকমে চলছিলো।
মামুন স্ত্রীর যা আয় করে, তার কখনো হিসাব চায়নি।
সম্ভবত বিয়ের প্রথম থেকে সংসার নামক সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে যেয়ে মুখবুজে দিন পার করছিলো সুরমা।কারণ সুরমা বুজতে পারছিলো মামুন ঝোঁকের মাথায় বিয়ে করেছে।
বিভিন্ন সময় মামুনের চরিত্র নিয়ে কথা উঠেছে। গা করেনি সুরমা।
বাচ্চাগুলোই সুরমার বাঁচার অবলম্বন। ওদের হাসি মুখগুলো ভুলিয়ে দিতো মনের সব ঝড়।
শ্বশুর সাহেব মৃত্যুর আগে বসত বাড়ি ভাগাভাগি করে দিয়েছেন।
মামুন একমাত্র পুত্র সন্তান। আর দুটো মেয়ে আছে।
আট কাঠার মত জায়গা পেয়েছে। জমানো টাকা দিয়ে তিন কামরার আধাপাকা ঘর করেছে সুরমা।
সংসার সামলিয়ে বেশ ভালই যাচ্ছিল।
দুটো ঘরে ওরা থাকে। একটাতে বাচ্চা পড়ায়।
সুরমা ভালো ছাত্রী হওয়ার কারণে ছাত্রের অভাব হয়নি।
রাস্তার ধারের জায়গায় একটা মুদিখান করলে মন্দ হয়না।
চিন্তা এলো এই কারণে মামুনের সুতাকল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আয়ের ভালো একটা অংশ থাকবেনা।
সুরমা জীবনকে ভালো ভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে।সংগ্রাম সুরমাকেই করতে হবে।
মামুনের নিত্য নতুন যুবতীর সান্নিধ্য প্রয়োজন।
সুরমার পুরাতন শরীরে চেলা কাঠের আর মাছের আষ্টে গন্ধ।
মামুন ডুবে থাকে নতুন নতুন মদিরায়।
সুরমা অনেক চোখের জল ফেলেছে।কাজ হয়নি। তাই এখন আর মনকে বিস্বাদগ্রস্ত করেনা।
নিজেই টিন কেনে। বাঁশের খুটি কেনে। ছেলে মায়ের কাজে সাহায্য করে।
ফ্লোরটা পাকা না করলে ইঁদুরের উৎপাতে মাল নষ্ট হতে পারে।
কিছু টাকা বেশি হলে সমস্যা থাকতো না।
সাহায্যের হাত পাতে সুরমা। কে না সুরমাকে শ্রদ্ধা করে- ভালোবাসে।
পুরাতন ইট কিনে ভ্যানের ওপর বসে স্বপ্নের জগতে আসে।
দোকান হলো।মামুন মাঝে মাঝে উঁকি দেয়।
ভোরে উঠে শ্যামবাজারে যায়।ভ্যানে করে কিছু কিছু মাল তোলে।দোকানটা সাজায়। সুরমা স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকে।
পরিচিত মহলই সুরমার কাস্টমার। দাম ওজন এবং ব্যবহার দিয়ে স্বপ্নদের রঙ্গিন করে তোলে।
ঁ
একা সামাল দিতে পারে না। বাবুটা স্কুলের ফাঁকে ফাঁকে দোকানে বসে।
দেখতে দেখতে বেশ কটা বছর চলে গেলো।
বড় খুকীর মেজ খুকীর বিয়ে হয়ে গেলো।
ছোটটাও উপযুক্ত হয়েছে।একটা কর্মচারী রাখা হয়েছে। সুরমা ক্যাশে বসে। বয়স হয়েছে।কিন্তু অভাবের কষাঘাত নেই।তাই এখনো সতেজ আর সবল সুরমা।
ক্যাশে বসে থাকার দরুন পা দুটো ফুলে উঠে। ইউরিনে জ্বালা জ্বালা ভাব।রাত্রিরে রাত্রিরে শরীরে জ্বর আসে।
নিজেই একদিন সময় করে ডাক্তারের কাছে যায়।
অনেকটা ক্ষতি হয়ে গেছে কিডনির।
জ্বরের মাত্রা মাঝে মাঝে খরস্রোতা নদীর বালু চরের মত জীবন থামিয়ে দেয়।
বড় মেয়েকে মাঝে মাঝে খবর পঠায়। ওর ভরা সংসার।
সময় করতে পারে না। মেজো শ্বশুর বাড়ি সামলিয়ে মায়ের খোঁজ নিতে তেমন পারেনা। তবু নেয় দুবোন।
এদিকে হয়েছে আর এক জ্বালা। গেন্ডারিয়া আর আগের মত নাই।
ডেভলপারের বদৌলতে অনেকে নয়তলা করে নিয়েছে।
সুরমা ভাবে আগামীতে এ বাড়িটা ডেভলপারকে দেবে।নীচতলায় বিশাল স্বপ্নের দোকান হবে।
শত বাধায়ও সুরমা দোকানটা আগলে রেখেছে।
রাতে জ্বরের মাত্রা বেশি ছিল।পরেরদিন দোকানে বসতে পারেনি।
একটু সুস্থ হলে দোকানে যায় সুরমা।ক্যাশে বাবু বসা।
মাকে দেখে বলল তুমি রেস্ট নাও।
সেই যে রেস্টে গেলো আর ক্যাশে বসতে দিলোনা বাপ ব্যাটা।
সুরমা এখন অনেকটাই সুস্থ। দোকানের সামনে বসে বেঁচা বিক্রি দেখে।
অপেক্ষা করে রাতের জন্য! হিসাব মিলাতে হবে। পাওনাদারদের টাকা ফেরত দিতে হবে।
- হ্যা রে বাবু! ক্যাশ মিলাবিনা?
* মিলাইতো।
- আমিতো হিসাব দেখিনা!
*তোমার দেখার দরকার নাই।চলছে তো।ভয় কী? আমরাতো আছি।
সুরমা দোকানটা ভালো করে দেখে। ভ্যান গাড়ির ওপর ইট,বাঁশ- খুটি, চাল ডাল তেল মসলা!
রাতভর মাল মসলাগুলো সাজানো!
ভোরে দোকান খোলা! কর্মচারী এলে ছুটে গিয়ে সন্তানের - স্বামীর নাস্তা তৈরি করে আবার দোকান সামলানো!
কষ্ট আর কষ্ট। এখন কত বড় হয়েছে দোকান।
রাস্তায় দাঁড়ায় সুরমা। চোখ তুলে তাকাঁয় সাইনবোর্ডে! " সুরমা ষ্টোর"।
হাতের কাগজটা ঘর থেকে নিয়ে উঠোনে দাঁড়ায়।
সুরমা শিক্ষিত মেয়ে, "তুমি মেয়ে মানুষ!
এ পৃথিবীতে তোমার নিজস্ব কিছু থাকতে নেই।"
বত্রিশ বছর তুমি স্বপ্নের মহল তৈরি করেছো।
নুতনত্ব চায় পৃথিবী ।
সুন্দর ঝকঝকে লেখা - " মায়ের দোয়া স্টোর"
স্বপ্নের মহলে বাস করা যায় না সুরমা।
বিবেক বন্ধ করে ঘুমিয়ে বাস করো তুমি!
তুমি সুরমা, যা একটা মেয়ের নাম।
# অবসর মুহূর্ত।
-ভেলোর, ইন্ডিয়া।
# ইয়াসমীন রাব্বানী লিলি।
Comments (0)