সকাল সকাল শাশুড়ির রুমে এসে দাঁড়িয়ে আছি। আমার ঠিক দুইপাশে তিনজন জা দাঁড়িয়ে আছেন।
বিয়ে হয়ে শ্বশুর বাড়ি আসলাম মাত্র একদিন হলো। একদিন যেতে না যেতেই সকাল সকাল এমন করে শাশুড়ির তলব পেয়ে আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। জা’দের কাছে জিজ্ঞেস করব তার সুযোগই পেলাম না। সবাই হন্তদন্ত হয়ে শাশুড়ির রুমে এসে হাজির।
শাশুড়ি খুব গম্ভীর হয়ে বললেন, ভয় পাওয়ার কারণ নাই ছোট বউ। বাড়ি উত্তরে একখান জামরুল আর কতবেল গাছ আছে। এই দুই গাছের মাঝামাঝি একটা নারিকেল গাছ লাগানোর দায়িত্ব তোমার। শুধু লাগালেই হবে না, মাঝে মাঝে যত্নআত্তিও নিবা।
বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি আসলাম মাত্র একদিন হল। এর মধ্যে নারিকেল গাছ লাগানোর কথা শুনে আমার ভয় যেন যেমন বাড়ল তেমনি রাগও হলো। এই কোথায় এসে আমি পড়লাম! আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি দেখে শাশুড়ি একটু কঠিন করে বলল, কথা বুঝো নাই বউ?
আমি বললাম, বুঝেছি আম্মা।
বুঝলে ভালো। বড় বউ তোমারে সব দেখায়ে দিব। এই বাড়ির বউ হইয়া আইছো। কাজকর্ম মন দিয়া করা লাগব ছোট বউ।
জ্বী আম্মা।
আমার শাশুড়ি এবার একটু রাগী চোখে মেজ জা’য়ের দিকে তাকাল। মেজ জা আমতা আমতা করতে করতে বলল, আম্মা দোষ টা আমার। আমাকে আপনি ক্ষমা করে দেন। এমন ঘটনা আর হবে না।
কথাটা শেষ করে মেজ ভাবি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। মেজ ভাবির কান্না দেখে শাশুড়ি খুব রেগে গিয়ে বললেন, দোষ যে তোমার সেটা তো আমি আগেই জানতাম। তোমার তো কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত বউ। তোমার বাপের বাড়ি খবর দেওয়া উচিত। কিন্তু আমি চাই না এই বাড়ির খারাপ কোনো সংবাদ বাইরের মানুষের কানে যাক। এই বিচার আমি একা করব। এই সংসার আমার। এখানে অন্যায় কিছু আমি বরদাসত করব না।
কথা শেষ করে শাশুড়ি বিড়বিড় করে কী সব পড়লেন। আমরা দাঁড়িয়ে আছি। আমি কী করব বুঝতে পারছি না। হঠাৎ করে শাশুড়ি বললেন, তোমরা যাও।
শাশুড়ির রুম থেকে বের হয়ে আসার পর আমার কাছে সবকিছু কেমন উল্টাপাল্টা লাগছে। মেজ ভাবির কান্না দেখে আমার খুব খারাপ লেগেছে। যদিও আমি বুঝতে পারছি না বিষয়টা কী। তারপরও এখন শাশুড়ির উপর খুব রাগ হচ্ছে। একজন শাশুড়ি যদি এমন করে বাড়ির বউদের শাসন করে তবে তা কিছুতেই মেনে নেওয়া যাবে না। আমিও খান বাড়ির ছোট মেয়ে। আমার উপর এসব খবরদারি চলবে না।
আমি মনে মনে ঠিক করলাম গাছ আমি লাগাবো না। ইচ্ছে করেই লাগাবো না। দেখি শাশুড়ি আমার কী করে। আজ কয়েকবার বড় ভাবি গাছ লাগনোর জন্য তাগিদ দিয়েছে কিন্তু আমি এড়িয়ে গিয়েছি। ইচ্ছে করে এড়িয়ে গিয়েছি। সকাল থেকে কয়েকবার বলার পর দেখি বড় ভাবি এই নিয়ে আর কিছু বলছে না। ভালোই হলো। শাশুড়ি বুঝুক আমার উপর অত সহজে খবরদারি করা যাবে না।
একান্নবর্তী পরিবার। বহরপুর বাজারে আড়তের ব্যবসা। বিশাল ব্যবসা। চার ভাই এই আড়তেই বসে। তাছাড়া এলাকায় ব্যবসা এবং জমিজমা নিয়ে এই পরিবারের বেশ নাম-ডাক আছে। শুনেছি আমার শ্বশুর গত হয়েছেন প্রায় সাত বছর হতে চলল। এই বাড়ির চার ছেলেই মায়ের ভীষণ ভক্ত। মা যা বলেন বিনা বাক্যে ছেলেরা তা মেনে নেয়। ছেলেদের কথা হলো মা যতদিন আছে আমরা সব ভাই একসাথে। আলাদা হওয়া, আলাদা চিন্তা করার সুযোগ নেই। এই নিয়ে বাড়ির বউদের কোনো অভিযোগ কাজে লাগবে না। বাড়ির বেশির ভাগ বিষয়ে এই শাশুড়ি সিদ্ধান্ত দেন। আর সেই সিদ্ধান্তে বাড়ির ছেলেদের খুব একটা দ্বিমত নেই এবং থাকেও না।
মেজ ভাবির কাছে এসব শুনে আমার রাগ আরো বাড়ল। এটা অন্যায়। একজন মানুষ এমন করে সবার উপর কর্তৃত্ব করবেন তা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। মনে মনে রাগ পুষে রাখলেও কাউকে কিছু বললাম না।
প্রায় সাতদিন হতে চলল। শাশুড়ির সাথে বেশ কয়েকবার দেখা হলেও গাছ লাগানোর বিষয়ে কিছু বললেন না। আমিও মনে মনে ভাবলাম ভালোই হলো। শাশুড়িকে এই একটা শিক্ষা দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছি আমিও খান বাড়ির মেয়ে। আমার উপর এমন করে খবরদারি চলবে না। অন্যায় ভাবে বাড়ির অন্য বউদের শাসন করলেও আমাকে পারবে না।
খুব অল্প সময়ে এই বাড়িতে আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ হয়ে উঠলেন বড় ভাবি। চুপচাপ আপন মনে কাজ করে চলেন। কোনো বিষয়ে বিচলিত হতে দেখি না। বাড়ির অন্য বউয়েরাও দেখি বড় ভাবিকে বেশ পছন্দ করেন। তবে এই বাড়িতে এসে একটা বিষয় শুনে বেশ কষ্ট পেয়েছি। বড় ভাবি নিঃসন্তান। ঢাকায় গিয়েও অনেক বড় ডাক্তার দেখিয়েও কোনো কাজ হয়নি। তবে এই বাড়ির বাচ্চা-কাচ্চারা বড় ভাবির ভীষণ ভক্ত। মনে হয় তাদের সব আবদার এই বড় মায়ের কাছে। বাড়ির সব ছেলে মেয়েদের পড়ালেখা খাবার-দাবার সবকিছুর খবর যেন বড় ভাবির কাছে। এই নিয়ে কারো কোন অভিযোগও নেই। এসব দেখে বড় ভাবির প্রতি আমার শ্রদ্ধা এবং মায়া যেন আরো বেড়ে গেল।
সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। একদিন দেখি বড় ভাবি চোখ মুছতে মুছতে আমার শাশুড়ির রুম থেকে বের হচ্ছে। ভাবিকে এমন করে দেখতে আমার খুব কষ্ট হলো। ভেতরের রুম থেকে শাশুড়ি কী সব বলে চিৎকার চেঁচামেচি করে করছেন। বড় ভাবির মতো এমন একটা মানুষকে বকতে পারে তা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। কী এমন করল যে ভাবিকে এভাবে বকতে হবে! এটা দেখার পর শাশুড়ির উপর আমার রাগটা যেন আরো বাড়ল।
সন্ধ্যার দিকে শাশুড়ি আমাকে ডাকলেন।
কেমন আছো ছোট বউ?
ভালো আম্মা।
ইসমাইলের সাথে তুমি নাকি খুব রাগারাগি করছ?
এই সংবাদ আপনার কানে আসল কেমন করে?
সংবাদের বিষয়ে তুমি কি আমার কাছে কৈফিয়ত চাও বউমা?
কৈফিয়ত কেন আম্মা? আমাদের স্বামী স্ত্রীর মাঝে একটু মান-অভিমান হতে পারে তাই বলে সেই সংবাদ আপনার কাছে আসবে, আপনি সেটা নিয়ে আমার বিচার করবেন সেটা তো ঠিক না আম্মা।
কোন টা ঠিক, কোন টা বেঠিক সেটা বোঝার ক্ষমতা তুমি এখনো অর্জন কর নাই ছোট বউ। এই বাড়িতে তোমার বড় ভাইরে আমি আসতে না করছি। এখানে ইসমাইলের কোনো দোষ নাই। এই নিয়ে তুমি আর কোনো আওয়াজ তুলবে না।
আম্মা কাজটা কি আপনি ঠিক করলেন?
বলেছি তো কোন টা ঠিক আর কোনটা বেঠিক সেই জিনিস বোঝার ক্ষমতা তোমার হয় নাই। তুমি এখন যাও ছোট বউ।
আমার রাগ যেন বাড়ছিল। ইচ্ছে করছিল শাশুড়িকে আরো কিছু কথা শুনিয়ে আসি। কিন্তু রাগটা এতো বেড়ে গিয়েছিল যে আমার মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছিল না। শাশুড়ির রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে একা একা কিছুক্ষণ কাঁদলাম। আমার স্বামী ইসমাইলের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে। গতকাল এই বাড়িতে আমার বড় ভাই আসার কথা ছিল জিনিসপত্র নিয়ে। আমি শুনেছি ইসমাইল বারণ করেছে। এই নিয়ে ইসমাইলের সাথে আমার বেশ কথা কাটাকাটিও হয়েছে। আজ যখন বিষয়টা শাশুড়ির মুখে শুনলাম তখন রাগটা আরো বাড়ল। সবকিছুতে শাশুড়ির এমন খবরদারি মেনে নিতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমার বাড়ি থেকে কিছু জিনিসপত্র দিতেই পারে। কিন্তু তা আনতে এভাবে বারণ করা অন্যায়। মনে মনে ভাবলাম, আমিও খান বাড়ির মেয়ে। এই নিয়ে একটা বিহিত আমি করব।
রাতে ভাবিরা একে একে সবাই এসে খেতে ডাকল। আমি জানিয়ে দিলাম খাব না। ইসমাইলও অনেক জোরাজুরি করল। আমি বেশ শক্ত। কিছুতেই আজ খাব না। শেষে সবাই বুঝে নিয়েছে আমি বেশ কঠিন ধাঁচের মেয়ে। আমাকে খাওয়ানো্র আশা ছেড়ে দিয়ে সবাই ডাকাডাকি বন্ধ করল। আমিও মনে মনে ভেবে রেখেছি, এবার শাশুড়িকে একটা উচিৎ শিক্ষা দিয়ে তবে আমি শান্ত হব।
রাত এগারো টার দিকে বড় ভাবি এসে বলল, হেনা আম্মা তোমায় ডাকছে।
আমি কিছু না বলে শাশুড়ির রুমের দিকে রওনা দিলাম। মনে মনে ভাবলাম এই সুযোগ। অতো সহজে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। রুমে ঢুকে দেখি শাশুড়ি কোরআন তেলওয়াত করছেন। আমাকে ইশারা করলেন বসার জন্য। আমি বসলাম ছোট টুলে।
আমি চুপচাপ বসে আছি। শাশুড়ি একটা হালকা আওয়াজে তিলওয়াত করছেন। তিলওয়াত খুব মিষ্টি লাগছে। যদিও আমার ভেতরটা রাগে ফুসছে কিন্তু কেনজানি এই তিলওয়াত আমার খুব ভালো লাগছে শুনতে। রুমটা বেশ গোছানো। এই রুমে আরো কয়েকবার আসা হলেও এমন মনোযোগ দিয়ে দেখা হয়নি কখনো। সবকিছু বেশ সুন্দর করে সাজানো আছে। যেটা যেখানে থাকা প্রয়োজন ঠিক সেখানে আছে। একটুও এদিক ওদিক নেই।
বেশি কিছুক্ষণ হয়ে গেল। আমার শাশুড়ির তেলাওয়াতের শেষ হয়নি। আমার এই তিলওয়াত শুনতে বেশ ভালো লাগছে। এতো সময় পেরুলেও আমার একটুও বিরক্ত লাগছে না। কেন জানি মনটা শান্ত হয়ে এসেছে। শাশুড়িকে আজ কিছু একটা বলে শায়েস্তা করার সাহসটাও যেন মিইয়ে গেল। আমি কী সব ভাবছিলাম। এমন সময় শাশুড়ি বলল, এসেছো বউমা?
জ্বী আম্মা।
ইসমাইল ঘুমিয়েছে?
শুয়ে পড়েছে। এতক্ষণে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে।
যাক ভালো হলো। তোমার সাথে এখন কিছুক্ষণ গল্প করা যাবে।
আমার ভেতর রাগ এখনো আছে কিন্তু কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না। তখন শাশুড়ি বলা শুরু করল,এই বাড়ি তে আমি বউ হয়ে আসি মাত্র ষোল বছর বয়সে। কলেজে উঠতেই বিয়ে হয়ে গেল। নিজের ভেতর কত রকম স্বপ্ন ছিল। বিয়ের পর ভাবলাম সব শেষ। রান্না-বান্না, স্বামী-সন্তান এই নিয়েই যেন জীবন। আস্তে আস্তে সংসার বড় হতে লাগল। ঘরবাড়ি, জমিজমা, সম্পত্তি সব যেন আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল। কিন্তু এই বাড়ির বউ হয়ে আসা এই আমি ঠিক আগের মতই আছি। বাবার বাড়ি থেকে সবকিছু ছেড়ে বসতি করলাম এই শ্বশুরবাড়ি।নিজের জীবনের বিশাল একটা সময় এই সংসারের পেছনে দিয়েও মনে হতে থাকে আমি শুধু এই বাড়ির বউ। সবাই আমাকে অমুক বাড়ির বউ বলে চিনে। এত কিছু করেও আমি এখনো অমুক বাড়ির বউ। রাশেদের মা, ইসমাইলের মা তো খুব কদাচিৎ।
শাশুড়ি একটা দীর্ঘশ্বাস দিয়ে বললেন, আমাকে দেখে তোমার মনে হতে পারে এই বাড়ির সবকিছুর হর্তাকর্তা বুঝি আমিই। চাইলেই অনেক কিছু করতে পারি। হ্যাঁ পারি, এখন চাইলে অনেক কিছু করতে পারি মা । তবে নিজের জন্য কিছুই তো করতে পারি না। আমার বিয়ের বছর খানেক পর ছোট ভাইটা মারা গেল টাইফয়েডে। টাকার অভাবে ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে পারেনি। আব্বা তো সামান্য স্কুল মাষ্টার। আব্বাকে কত কিছু খাওয়াতে ইচ্ছে করত। অথচ এই সংসারের কোনো কিছুই আমার হাতে নেই। স্বামীর কাছে বলে কোনো লাভ ছিল না। দুর থেকে বড় বাড়ির বউ হয়ে আমি শুধু চোখের পানিই ফেলেছি। ছোট বোনটার বিয়েতে একটা স্বর্ণের জিনিস দেওয়ার কথা ছিল। শেষে আমার শ্বশুর না করলেন। সে যে কী কষ্ট আমার। বোনের বিয়েতেও গেলাম না। আমি শুধু এই বাড়ি ব্উ হয়ে রইলাম।
শাশুড়ি এবার একটু থামলেন। আমি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছি আমার শাশুড়ির দিকে। আমার কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে না। আমার শাশুড়ি আবার বলা শুরু করল।
এখন আমার হাতে অনেক কিছু আছে। ছেলেদের বললে অনেক কিছু হয়ে যাবে। কিন্তু আমার তো আর কেউ নেই মা। বাবা-মা মারা গেছেন সেই কবে। ভাইটা তো মরেই গেল। বোনেরাও এখন বেশ ভালো আছে। আমার নিজের জন্য যে কিছুই করার নেই।
শাশুড়ি একটু চঞ্চল হয়ে উঠে বলল, তুমি বোধহয় রাগ করেছ এই বাড়িতে আসতে না আসতে তোমাকে আমি গাছ লাগানোর কথা কেন বললাম?
আমি আমতা আমতা করতে করতে শাশুড়ি বলল, আমি তো জানি তুমি রাগ করে সেই গাছ লাগাও নি। আমিই বড় বউকে বারণ করেছি এই নিয়ে তোমাকে যেন কিছু না বলে। মা, আমি চাই এই বাড়ি তোমাদের হোক। বাড়ির উত্তর পাশে বড় নারিকেল গাছটা লাগিয়েছে এই বাড়ির বড় বউ। তার পাশের নারিকেল গাছটা সেজ বউ। পুব দিকের লকলকিয়ে বড় হওয়া নারিকেল গাছটা মেজ বউ লাগিয়েছে। এই গাছগুলো এই বাড়ির বউদের লাগানো বুঝতে পেরেছ। গাছ গুলো দিন দিন বড় হবে। এই বাড়ি ছায়া দিবে, ফল দিবে। তার চেয়ে বড় কথা, এই গাছ গুলো এই বাড়ির চারপাশ ঘিরে রাখবে তা শুধু না, এই গাছ গুলো দেখলে তোমাদের ভেতর একটা সাহস আসবে। লম্বা হয়ে এই গাছ গুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে এই গাছ। দুর থেকে দেখলে মনে হবে এই বাড়িটা তোমরা আগলে রেখেছ। তাছাড়া বাড়ির পুরুষ মানুষগুলো এসব গাছ দেখলে বুঝতে পারবে এই বাড়ির বউয়েরা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের অসম্মান করা অতো সহজ নয়। তোমাদের শেকড় এই বাড়ির মাটির সাথে শক্ত হয়ে আছে। এই বাড়ি যে তোমাদের। এটা আমাদের বাড়ি। আমার এই বউদের বাড়ি।
রাগ, ক্ষোভ নিয়ে যেই আমি এই শাশুড়ির রুমে বসে প্রতীক্ষা করছিলাম শাশুড়িকে আজ হেনস্তা করে ছাড়ব, সেই আমি চোখের জল আটকে রাখতে পারছি না কিছুতেই। আমি কাঁদছি বাচ্চাদের মতো করে। আমার কান্না মনে হয় না শাশুড়ি খুব একটা দেখছেন। তিনি আপন মনে গল্প করে চলেছেন। আম্মা এবার একটু রাগ দেখিয়ে বলল, বড় বউয়ের উপর আমার খুব রাগ। রোজ দিন আমার কাছে এসে কান্নাকাটি করে।আমি বললাম, কেন আম্মা?
কেন আবার, নিজের কপালে নিজে কুড়াল মারতে চায় মেয়েটা। এমন বোকা হলে চলে! আমার বড় ছেলের আবার বিয়ে দিতে চায়। সেতো সন্তান দিতে পারল না। আবার বিয়ে করালে নাকি নতুন বউয়ের সন্তান হবে। আমি বলে দিয়েছি আমি জীবিত থাকতে এবং আমি মারা গেলেও এই কাজ হতে পারবে না। আল্লাহ তাদের কপালে সন্তান রাখে নাই। বাড়িতে আরো ছেলে মেয়ে আছে। আমার ছেলের বংশ নিয়ে নিয়ে বড় বউয়ের চিন্তা করার দরকার নাই। কত বড় বেআক্কেল মেয়ে দেখছ। খুব ভালো করে বকেছি মেয়েটারে। আমার খুব খারাপ লাগে এমন করে বকতে। কিন্তু এসব শুনলে মাথা কি আর ঠিক থাকে।
আমার শাশুড়ি এবার একটু শান্ত হয়ে বলল, আমারে একটু পানি দাও মা। অনেক কথা বলে ফেলেছি। গলাটা শুকিয়ে গেল কাঠ হয়ে গেল।
পানি খেয়ে গ্লাস টা হাতে রেখেই তিনি বললেন, কিছু জিনিসপত্র মানে ফার্ণিচার নিয়ে তোমার ভাই আসতে চেয়েছিল। আমি না করেছি। আমি জানি এই নিয়ে তুমি খুব রাগ করেছে মা। কিন্তু আমি যে তোমার বাপের বাড়ি থেকে এসব নিতে পারব না। আমি বেঁচে থাকতে এসব জিনিস এই বাড়িতে ঢুকবে না। এটা অন্যায় মা। আমি জানি তোমার বাপের অনেক সহায় সম্পত্তি। এসব তোমার বাপে খুশি হয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এসব আমার বাড়িতে ঢুকলে আমার অন্য বউদের মনটা ছোট হয়ে থাকবে। আমার সব বউদের বাপের বাড়ির অবস্থা তো তোমাদের মতো না মা। তারা চাইলেও কিছু দিতে পারবে না। তাছাড়া ছেলেদের বিয়ে দিয়ে কোনো জিনিস আমি এই বাড়িতে আনব না এটা আমার আগে থেকেই শপথ করা। এই নিয়ে তুমি আর কিছু মনে করো না মা। আমি বলে দিয়েছি, তোমার বাড়ির লোকজন যেন যখন তখন আমার বাড়ি বেড়াতে আসে। তারা বেড়াতে আসলে আমার খুব খুশি লাগবে।
একটু দুরে বসা ছিলাম আমি। উঠে গিয়ে আমার শাশুড়ির কাছে গিয়ে বসলাম। কাছে যেতেই আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিলেন। তিনি দেখছেন আমি কাঁদছি। অথচ তিনি একটিবার কাঁদতে বারণ করল না।
আমার শাশুড়ির কোলে মাথা গুজে আমি শুয়ে আছি। তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলছেন, আমি জানি মেজ বউয়ের শাস্তির কথা শুনে তুমি ভয় পেয়েছ। ভয়ের কিছু নাই মা। মেজ বউ অন্যায় করেছে। এই অন্যায় আমার মেয়ে করলেও আমি একই শাস্তি দিতাম।
কী করেছে আম্মা?
গত ঈদে আমি সব বউদের হাতে কিছু টাকা দিয়েছি তাদের বাপের বাড়ির লোকজনের জন্য কেনাকাটা করতে। মেয়েরা সবসময় তো বাপের বাড়ির জন্য কিছু করতে পারে না। ভাবলাম ঈদে মেয়েরা নিজের হাতে, নিজের মতো করে কিছু উপহার দিক। এতে তাদের মনটা বড় হবে। অথচ আমার মেজ বউ করল কী সেই টাকা নিজের কাছে রেখে দিল। একটা টাকাও খরচ করল না। আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছি ছোট বউ। টাকা লাগলে বলত। মানুষ এতটা ছোট মনের হয় কী করে! ঘটনা শুনে আমি নিজে লোক পাঠিয়ে কেনাকাটা করে বেয়াই বাড়ি পাঠালাম।
শাশুড়ির কোলে মাথা গুঁজে আমি শুয়েছিলাম। আমি মাথা তুলে একবার শাশুড়ির মুখটা দেখলাম। আমার কেন জানি মুখটা দেখতে খুব ইচ্ছে করল। শাশুড়ি ছোটখাটো মানুষ। সেই ছোটখাটো মানুষের ছোটখাটো মুখটা দেখতে আমার কেন জানি আজ বিশাল মনে হচ্ছে। পৃথিবীতে এত সুন্দর মানুষ দেখতে চাইলেও দেখা যায় না। এমন মুখটা দেখার জন্য প্রতীক্ষা করতে হয়। আজ আমি সেই সুযোগ পেয়েছি। আমার ইচ্ছে করছে আজ সারাটা রাত এই মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকি।
চলো বউমা, রাত অনেক হয়েছে। এবার আমরা খাওয়া-দাওয়া করি। শাশুড়ি হুট করে বলে উঠলেন।
আপনি খান নি আম্মা?
আমার বাড়ির ছোট মেয়েটা না খেয়ে আছে আর আমি মা হয়ে খেয়ে নিব তা হয় কেমন করে! এই বাড়িতে এমন নিয়ম কখনো ছিল না।
এবার আমি ঠিক বাচ্চাদের মত হাউমাউ করে কেঁদে আম্মাকে জড়িয়ে ধরলাম। আম্মার বুকে মাথা গুঁজে আমি শুধু একটা কথায় বললাম, আমাকে ক্ষমা করে দেন আম্মা।
------রুহুল আমিন
Comments (0)