Search

ফড়িং মৃত্যুর গল্প

  • Share this:

গল্প : ফড়িং মৃত্যুর গল্প

ঘামে ভেজা গামছাটা বিরক্তি নিয়ে দূরে ফেলে উঠানের ছায়ায় বসলো আনিস। বৈশাখ মাস, তাপমাত্রা প্রচন্ড গরম। মাথার উপর সূর্যটা নিজের কঠিন রূপ দেখাচ্ছে।

আনিসের চোখমুখ গরম, ঘামাচ্ছে। ভীষণ বিরক্তি নিয়ে আনিস বিরবির করে বলতে লাগলো, বালের গরম, কোন শান্তি নাই, এমনে কি চলা যায়, বাঁচা যায়।

আনিস মুখ খুললো এবার। বলল,

“তোগো মা আর মাইয়ারে কি বসাইয়া খাওয়ার জন্য রাখছি? গরমে মরতেছি আর কারো কোনো খবর নাই।

এক গ্লাস পানি দেওয়ার নামগন্ধ নাই।”

আনিসের রেগেমেগে বলা কথা শুনে চুলোর কাছে মালাকে থাকতে বলে এক গ্লাস পানি হাতে নিয়ে ভয়ে ভয়ে আনিসের কাছে এসে দাঁড়ালো কুসুম।

মুখটা মলিন করে কুসুমের দিকে তাকিয়ে হাত

বাড়িয়ে পানিটা নিয়ে একটানে পানিটা খেলো আনিস।

শাড়ীর আঁচল কোমরে বেঁধে আনিসের পাশে বসলো কুসুম। কুসুমকে বসতে দেখেই আনিস দেরি না করে বলল, “মাথাটা টিপে দে, গরমে মাথা ঘুরতেছে।”

বাধ্য বাচ্চার মত মাথা টিপে দিতে লাগলো কুসুম।

সুখে আনিস চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিতে লাগলো।

কুসুমের ভয়টা এখনো কাটলো না। ভয়ার্ত গলায় আনিসের উদ্দেশ্যে বলল, “একটা কথা আছিলো।”

মাথা নাড়িয়ে আনিস সায় দিলো।

অভয় পেয়ে কুসুম বলল,

“আসমত ভাই আমাগো মালার জন্যে একটা সমন্ধ নিয়া আইছে। পোলা দেখতে শুনতে নাকি উঁচা লম্বা, বেশ ভালা। নামডাক আছে বংশের। আপনে কইলে আসমত ভাইরে কইতাম পোলার বাড়ি থেইকা মালারে দেইখা যাইতে।”

আনিস নড়েচড়ে বসলো। মাথাটা চুলকাতে চুলকাতে বলল, “দেখতে আইলেই তো খরচ। পকেটেও টাকা নাই তেমন। রিকশা নিয়া সারাদিন বইসা থাকতে হয়। গরমে মানুষজন বাহির হয় না বাড়ি থেইকা। মাইয়া'ডাও বড় হইছে। বিয়াশাদী দিতে হইবো। কই যে যাই!”

আনিসের কথা শুনে কুসুমের মুখটা বাঘের সামনে থাকা অসহায় হরিণের মত শুকিয়ে গেলো।

মিনিট দুই নিরব থেকে আনিস আবারো বলল,

“আসতে বল। ভালো পোলা তো সহজে পাওয়া যায় না।

হাতছাড়া করা যাইবো না পোলা ভালো হইলে। মাইয়ার বিয়া তো আজ না হয় কাইল দিতেই হইবো।”

কুসুম মাথা নাড়ালো। আনিস আবারো চোখ

বন্ধ করা মাত্র ওর মাথায় হাত বুলাতে লাগলো কুসুম।

.

মোরশেদের শরীরটা আজ ভালো না। পুরো শরীরে ব্যথায় ভরপুর। কাজে যায় নাই আজ। সারাদিন শুয়ে আছে। যদিও ওর মন ইদানিং কাজে বসে না। রাজমিস্ত্রী হেল্পারের কঠিন কাজ একসময় পারবে না বলার পরেও কাজটা ঠিকই শরীর সয়ে নিয়েছিলো মালার জন্যে।

মোরশেদের চোখে ঘুম লেগে যেতেই ওর মায়ের চিৎকার চেঁচামিচিতে উঠে বসতে বাধ্য হলো।

অবশ্য ওর উঠতেই হতো। বিকালে মালার সাথে দেখা করার কথা ওর। হয়তো মালা এতক্ষণে অপেক্ষাও করছে ওর জন্য।

বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে মোরশেদ বের হলো।

শরীর চলছে না। তবুও হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো।

দূর থেকেই মোরশেদের চোখ পড়লো মালা দাঁড়িয়ে আছে। মালাকে দেখেই ওর অস্থিরতা বেড়ে গেলো।

এক দৌড়ে মালার সামনে দাঁড়াতেই মালা বলল,

“আপনের আসতে এত সময় লাগে? সেই কহন থেইকা দাঁড়াইয়া আছি। মাইয়া মানুষ, বাঁকা চোখে তাকায় যেই দেখে। একটু তাড়াতাড়ি আসলেও তো পারেন।”

মোরশেদের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে।

দম নিয়ে মালাকে আশ্বস্ত করার জন্যে মোরশেদ বলল,

“কোন মাইনষে তোমারে দেহে? কার এত বড় কলিজা?”

“ঢং ছাড়েন। আমার মন মেজাজ ঠিক নাই।”

মালার কথা শুনে মূহুর্তেই মোরশেদের মত ব্যাকুল

হয়ে গেলো, 'মালার মনের কি হয়েছে জানার জন্য'।

মোরশেদ জিজ্ঞেস করলো, “কি হইছে মালা?”

গলায় জোর খাঁটিয়ে মালা উত্তর দিলো,

“আমারে কোন পোলা নাকি দেখতে আইবো। মার থেইকা হুনলাম পোলা নাকি ভালা, টেকা পয়সা আছে।

আমার মন মেজাজ কেমনে ভালা থাকে কন তো?”

মোরশেদ চুপ হয়ে গেলো। ও ফিরতি জবাবে কি বলবে ও জানে না। মালা আবরো বলল,

“আপনে একটু আব্বার সাথে কথা কন না! আপনে এমন চুপ থাইকেন না, আমার ম্যালা খারাপ লাগে।”

মোরশেদ বলল,

“আইচ্ছা, আমি কথা কমু নে তোমার বাপের লগে।”

মোরশেদ আর থাকলো না। কথাটা শেষ করেই বাজারের দিকে হাঁটতে লাগলো। মালা দাঁড়িয়ে মন ভরে নিজের মানুষটার চলে যাওয়া দেখলো।

পুরো সন্ধ্যা বাজার ঘুরেও মালার আব্বাকে পেলো না মোরশেদ। ওর মনে মালাকে হারানোর ভয় বাসা বেঁধেছে। কোন মতেই কোনভাবে শান্তি পাচ্ছে না।

.

আসমত মিয়া মুখ থেকে পানের অবশিষ্ট ফেলে আনিস আর কুসুমের উদ্দেশ্যে বলল, “তোমার মাইয়ার কপাল বেশ ভালা। ছবি দেইখাই পছন্দ কইরা ফেলছে।”

কুসুমের মুখে হাসি ফুটলো। মনে মনে কুসুম আলহামদুলিল্লাহ পড়তেই আসমত মিয়া বলল,

“হুনো, সোজা কথাবার্তা ক্লিয়ার কইরা লই। পোলাগো কিছু চাওয়া-পাওয়া আছে বুঝলা? পোলার মা একটা সাইকেল আর দশ হাজার টেকা ক্যাশ দাবী করছে।”

আসমত মিয়ার কথাটা শুনেই আনিসের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। আনিস কোনমতে বলল,

“সাইকেল, আবার দশ হাজার টাকা?!”

“টেকা পয়সা তো কোন ব্যপার না বাপু! আসল কথা হইলো তোমার মাইয়ার সুখ। মাইয়ার সুখ কিনতে একটু আধটু তো দিতেই হয় জামাইরে। তয় পোলাডা ভালা। হাতছাড়া কইরো না।”

আনিস ও কুসুমের কপালে নতুন চিন্তার ভাজ।

বিয়ের খরচ, আবার আলাদা করে এতগুলো টাকা!

আনিস বলল,

“আইচ্ছা, আপনে কথাবার্তা আগান।”

“ঠিক আছে।”

বলেই আসমত মিয়া উঠে বের হয়ে গেলো।

আসমত মিয়ার চলে যাওয়ার অনেকক্ষণ পর আনিস কুসুমকে বলল, “এতগুলো টেহা কেমনে জোগাড় করমু ক তো? মাথায় ধরে না।”

কুসুম বলল, “এক কাজ করেন আমার কানের জিনিস বেইচা দেন। কিছু টেহা তো আইবো হাতে।”

“ধুরো! মাইয়ার বিয়ার সময় মাইয়ারে সোনাদানা দিতে হইবো না? সেসব কই থেইকা দিবি? আমি দেহি কারো থেইকা দেনা করতে পারি কিনা।”

কুসুম কোন জবাব দিলো না। নিরবে লুকিয়ে চোখের জল ফেলে দিলো মাটিতে।

দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে মা বাপের কথা শুনে আর সহ্য করতে পারলো না মালা। মোরশেদকে পাওয়ার চিন্তার থেকেও এমূহুর্তে ওর চোখে ভাসছে ওর বাপের করুণ চেহারা।

.

কয়েকবার খেতে বলার পরেও মালা খেতে বসলো না।

ভাত আর তরকারি প্লেটে সাজিয়ে আনিসকে খেতে দিলো কুসুম। হাত ধুয়ে প্লেটে হাত দিতেই কুসুম বলল,

“কি করবেন ভাবছেন কিছু?”

“দেহি, সময় তো আছে। চিন্তা করিস না।”

“লতিফ বেপারী তো সুদের উপর টেহা দেয়। উনার

লগে একবার দেখা কইরা দেখেন যদি কিছু করা যায়।”

“এইটা অবশ্য ভালো কথা কইলা। কাল যামু নে।”

আনিস খেতে লাগলো। কুুসুম হাতপাখা ঘুরিয়ে বাতাম করতে লাগলো। আর ওদিকে মালা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনে চোখের পানি ফেলতে লাগলো।

.

মোরশেদ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ওর মুখের কোন কথাই নাই আজ। মালার চোখমুখে ক্লান্তির স্পষ্ট ছাপ।

মালা বলল,

“আপনে আমারে বিয়া করবেন তো? আব্বা খুব চিন্তায় আছে আমার বিয়া নিয়া। টেকা পয়সা ধারদেনা কইরা হইরেও বিয়া দিবোই দিবো।”

কথাটা বলেই মোরশেদের হাত ধরলো মালা।

আবার বলল, “লন না, কোনে যাই গা দুইজন।”

মোরশেদ চুপ। কোন জবাব নাই ওর মুখে।

মালা আবারো বলল,

“আমার কথা কি হুনতাছেন? একটু শান্তি দেন আমারে। আব্বার চিন্তা, আপনারে হারানোর চিন্তা আমারে শেষ কইরা দিতাছে। বিয়া কইরা বাড়িত যাই নয়তো চলেন কোথাও যাই গা।”

মালার হাত ছাড়িয়ে মোরশেদ নিচু গলায় বলল,

“আমি পারতাম না মালা। আমারে মারে একা রাইখা,

বংশের মুখে চুনকালি মাইখা পালাইতে পারমু না।

আমারে মাফ করো তুমি।”

মালা কিচ্ছু বলল না। চুপচাপ মোরশেদের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবলো, 'এই মানুষটারে আমি এতদিন ভালোবাসলাম!'

দু'জনের কেউই আর কোন কথা বলল না।

সন্ধ্যা নামার ক্ষনে দুজনের পথ বেঁকে গেলো দুদিকে।

.

মোরশেদের সাথে দেখা করে বাড়িতে ফিরেই ঘরের দরজা বন্ধ করে মুখে বালিশ চেপে ধরে অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলো মালা। জীবন বড় অসহায়!

রাত বাড়তে লাগলো। আনিস বাড়িতে ফিরলো।

বাপের গলার আওয়াজ শুনে ঘর থেকে বেড়িয়ে হাঁটাহাঁটি করতে লাগলো মালা।

কুসুমের মুখে চিন্তার ভাজ দেখে ঘামে ভেজা শার্ট খুলতে খুলতে আনিস বলল,

“লতিফ বেপারীর কাছে গেছিলাম। টেকার কথা কইলাম। রাজি হইছে। কিন্তু আমাগো বাড়ির দলিল জমা দিতে হইবো।”

কুসুম কোনমতে বলল, “কি করবেন তাইলে?”

“কাইল দলিল দিয়া টেকা লমু। মাইয়ার বিয়াটা দিমু। তারপর দেনা একটু একটু কইরা পরিশোধ করমু। আর যদি দেনা না দিতে পারি তাইলে ঘরছাড়া হইতে হইবো। চিন্তা করিস না সব হইবো সব। মাইয়ার বিয়াটা শুধু হইতে দে।”

কুসুম কোন কথা বলল না। আনিসও চুপ হয়ে গেলো।

.

ফজরের আজান হইলো কিছুক্ষণ আগে। চারদিকে ভোরের আলো ফুটছে। কুসুমের ঘুম ভাঙতেই মালার ঘরের দিকে চোখ পড়লো।

মালার ঘরের দরজা খুলতেই চোখে পড়লো মেয়ের শরীরটা ঘরের টিনের চালের খুঁটির মাথে ঝুলে আছে।

কুসুমের এক চিৎকারে আনিস উঠে আসলো।

বাড়ির আসপাশ স্তব্ধ। চারদিক যেন দম বন্ধ হয়ে গেছে মালার অকাল মৃত্যুতে। কি অসহায় মানুষজন!

মালার ঘরে একটা কাগজ পাওয়া গেলো।

এক ছোকরা পড়ে শুনালো,

"আব্বার টেকা লওয়া লাগবো না। চিন্তা করন লাগবো না। সবাই শান্তিতে থাকুক। আমার জইন্য যেহেতু এত চিন্তা, আমি না থাকলে কারো কিছু হইবো না! জীবন আমার যেমন হওয়ার হইলো।"

কথাগুলো শুনতেই কুসুমের কান্নার মাত্রা আরো বাড়তে লাগলো। চোখের সামনে নিজের মেয়ের মৃত্যু যে কোন মা'ই সহ্য করতে পারে না।

"বিয়ে কারো কারো জীবনে নিয়ে আসে মধুর সুখ,

আবার কারো জীবনে আগ বাড়িয়ে নিয়ে আসে মৃত্যু।"

.

সাইদুর রহমান তানিম

Tags:

About author
আমি গল্প এবং বই প্রেমিক একজন মানুষ। গল্প এবং বই পড়তে খুবই ভালোবাসি। যেখানেই যে গল্প অথবা কাহিনী খুজে পাই সেগুলো সংগ্রহ করি এবং আপনাদের সাথে শেয়ার করার চেষ্টা করি। আমি নিজেও কয়েকটি গল্প লিখেছি তবে সেগুলোর সংখ্যাটা খুবই সামান্য।