-"নিজের ছেলের বউকে ডাকিনী বলতে লজ্জা করছে না মা?"
-"বাবা, ঐ মেয়ে ডাকিনীই, ওরে বিশ্বাস করিস না। ঐ মেয়ে আমায় মেরে ফেলবে বাবা। ও আমাকে শাশুড়ি হিসেবে সম্মান তো দূরে থাক, আমি পড়ে থাকলেও খোঁজ নেয় না বাবা।" একনাগাড়ে কথা শেষ করে মা কাঁদতে লাগলেন বেশ জোরে। ভাইয়া মাথা নিচু করে মায়ের কথা শুনলেন। এদিকে আমি ঠিক পাশের রুমে বসে, আমার সামনে ভাবী রুম পরিষ্কার করছেন আর গজগজ করছেন, "হ্যাঁ আমিই তো ডাকিনী আর উনি তো সাধু। ছেলেকে ফুসলানো হচ্ছে আমার নামে? আমার ভালো তো সহ্যই হয় না তার।" মা একদিকে চিৎকার করে চলেছেন, অন্যদিকে ভাবী গজগজ করছেনই। আমি আর ভাইয়া এসবের মাঝে নির্বাক শ্রোতা। ভেবেছিলাম ঘটনা কিছুদিনের মাঝেই স্বাভাবিক হবে, হলো না। ভাবী জিদ ধরেছেন সংসার আলাদা করবেন। ভাইয়া বেচারা মাইনকার চিপায়।
ভাবী আর মায়ের মধ্যে কথা একেবারেই বন্ধ, দুজন দুজনের মুখের দিকে অবধি তাকান না। একে অপরকে দেখলেই চোখ ফিরিয়ে নেন। "ভাবী আর মায়ের সম্পর্ক ঠিক করতে কী করা যায়" এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা চলছে আমার আর ভাইয়ার মধ্যে।
-"মা আর ঢাবীর এসব যে কবে ঠিক হবে? মা কি ভাবীকে ভালোবাসেই না আর ভাবী? ভাবী কি মাকে সত্যিই সম্মান করে না?"
-"আরে নাহ! মা তোর ভাবীকে খুব ভালোবাসে। তোর ভাবীর জন্য গয়নাও গড়াচ্ছে কিন্তু জানিসই তো প্রেম করে বিয়ে করেছি তাই মা একটু রেগে আছে। আর তোর ভাবীও মাকে খুব ভালোবাসে শুধু প্রকাশ করতে পারছে না। এখন কি করা যায় বল।"
-"শোন ভাইয়া, এক কাজ করি। ভাবীকে কল করে বলি মা অসুস্থ আর মাকে কল করে বলি ভাবী অসুস্থ।"
-"আমরা তো বাড়িতেই আছি, সন্দেহ করবে না?"
-"কিছু একটা বলে বের হবো। তারপর বলব ভাবী কল করে বলছে ভাবী অসুস্থ আর ভাবীকে বলব মা কল করে বলছে তিনি অসুস্থ।"
-"এই না হলে আমার বোন।"
প্ল্যান অনুযায়ী আমি আর ভাইয়া বের হলাম। একটু পরেই মা কল দিল। বলল," মিহি, আমার মাথাটা ধরেছে খুব, ওষুধ আনিস তো আর পারলে তোর মহারানি ভাবীকে একটু কল দিয়ে বল আমার একটু যত্ন আত্তি করতে।" বলেই মা ফোন কাটলেন। আমি ভাইয়ার দিকে তাকালাম কিছুটা ভ্যাবাচাকা খাওয়ার মতো অবস্থায়।
-"কি রে ভ্যাবাচাকা খাইলি নাকি?"
-"আরে ভাইয়া, মা সত্যিই অসুস্থ। একদিক থেকে প্ল্যান কাজ করবে কিন্তু মাও যে ভাবীকে ভালোবাসে মেয়ের মতন করে, এটা উপলব্ধি করানো যাবে না।"
-"আচ্ছা অন্যকিছু ভাববো পরে। এখন নাহয় তোর ভাবীকে কল করে বলে দে মায়ের খেয়াল রাখতে।"
ভাবীকে কল দিয়ে মায়ের অসুস্থতার কথা বললাম। ভাবী কিছু না বলেই কল কেটে দিল। ভাইয়া অবশ্য এতে কিচুটা রাগ করল কিন্তু মুখে প্রকাশ করলো না। সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে কলিং বেল চাপলাম। আজব ব্যপার! দু'বার বেল চাপতেই মা ছুটে আসেন অথচ আজ কেউ দরজা খুলছে না। ভাইয়ার কাছে এক্সট্রা চাবি ছিল। দরজা খুলে আমরা ভেতরে ঢুকতেই দেখি ভাবী কোথাও নেই। মায়ের ঘরে ঢুকে দেখি মা শুয়ে আছেন। ভাইয়া বেশ কয়েকবার মাকে ডাকল তবুও মা চোখ খুললেন না। দুশ্চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়লো আমাদের। ডাক্তারকে কল দিল ভাইয়া। বাইরে থেকে রাগ না দেখালেও আমি বেশ বুঝতে পারছি বাড়িতে আজ একটা কুরুক্ষেত্র হবে। বুঝলাম না ভাবী মা অসুস্থ জানার পরও ভাবী মাকে ফেলে কই গেল আর কেন গেল। ডাক্তার সাহেব এলেন। জানালেন,"তেমন কিছুই না। বোধহয় ভুল করে বা কোন কারণে ঘুমের ওষুধ খেয়েছেন একটা যার কারণে ঘুমাচ্ছেন।" ঘটনা এখন স্পষ্ট হলো। মা চশমা ছাড়া চোখে দেখেন না। ভাবীকে খুঁজে না পেয়ে একাই ওষুধ খেতে নিয়েছেন আর সেখানেই বাঁধিয়েছেন গণ্ডগোল। মাথা ব্যথার ওষুধের জায়গায় ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেলেছেন। কিন্তু এখনো একটা বিষয়ে খটকা লাগছে যে ভাবী কেন মাকে এমন অবস্থায় ফেলে গেলো।
ভাবী বাড়িতে ফিরলেন রাত আটটা নাগাদ। মা তখনো বিছানায় শুয়ে। আমি আর ভাইয়া ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে। ভাবী আসতেই ভাইয়া ভাবীর গালে সজোরে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। আমি আটকানোর সুযোগটা অবধি পেলাম না। ভাবীর চোখ ভিজে উঠলো, অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ভাইয়ার দিকে তাকালো। ভাইয়া চিৎকার করে উঠলো,"তোমাকে কল করে বলেছিলাম মা অসুস্থ অথচ তুমি নাচতে নাচতে বাইরে চলে গেলে। মাথা ব্যথার ওষুধের জায়গায় মা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেলেছেন। ভুল করে যদি অন্যকিছু খেতেন? কি হতো ভেবেছো একবার? আর কি কিনতে গিয়েছিলে তুমি? কি এমন মূল্যবান জিনিস যা কিনতে পাঁচ ঘণ্টা লাগলো তোমার?" বলেই ভাইয়া ভাবীর হাতে থাকা শপিং ব্যাগ ছুঁড়ে মারলো ফ্লোরে। ভেতর থেকে একটা গিফট র্যাপ করা বক্স বের হলো। উপরে লেখা,"প্রিয় শাশুড়ি আম্মুর জন্য"। বেশ বড় করে স্যরি আম্মুও লেখা। ভাইয়ার রাগ তবুও বোধহয় কমলো না। অন্যদিকে, ভাবী কাঁদছেন। কাঁদতে কাঁদতেই ফললেন,"তোমাদের প্ল্যান আমি শুনেছিলাম যে তোমরা আমার কাছে মাকে অসুস্থ বলে কল দিবে আর মায়ের কাছে আমার নামে। এটাও বুঝতে পেরেছিলাম মা আমায় খুব ভালোবাসে। তাই তোমরা বের হওয়ার পরই মাকে সারপ্রাইজ দিতে লুকিয়ে বের হই। আমি বুঝতে পারিনি মা সত্যিই অসুস্থ ছিলেন।"পরবর্তী মুহূর্তে যা হলো তার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলো না। মা এসে বেশ জোরে ভাইয়ার ডান গালে চড় বসিয়ে দিলেন। রাগান্বিত স্বরে বললেন,"তোর সাহস কি করে হলো বাড়ির বউয়ের গায়ে হাত তোলার? ও আমার বাড়ির বউ, ওর উপর আমি রাগ করবো, আমি শাসন করবো আবার আমিই ভালোবাসবো কিন্তু তোর সাহস কী করে হলো আমার বাড়ির বউয়ের গায়ে হাত তোলার? আর কোনদিন যদি আমার এই মেয়ের চোখের দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতেও তাকাস তুই, তোকে ঘরছাড়া করবো আমি।" একটু থামলেন মা, তারপর বললেন,"বৌমা, কি আনলে দেখাবে না?" ভাবী বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে প্যাকেটটা তুলে মায়ের কাছে গেলেন। মা কড়া স্বরে নির্দেশ দিলেন,"এই দুটোকে বাড়ি থেকে বের করো। সারারাত বারান্দায় থাকলে মাথার ভেতর থেকে আজগুবি সব প্ল্যান করা বের হবে।"
সব ঠিক হলো। মা-ভাবীও এক হলো, মাঝখান দিয়ে আমরা ঘরছাড়া হলাম। ইশস! ভেতর থেকে মায়ের হাতের বিরিয়ানির গন্ধ আসছে। এ কেমন অত্যাচার! আমরা গেছিলাম মিলাইতে আর আমাদেরই ঘর থেকে বের করে দেওয়া হলো :)।
সমাপ্ত||
মা_ভাবীর_মিল
~মিহি
Comments (0)