ইফতারের ঘন্টা খানেক পূর্বে বাজার থেকে বড়সড় একটা ইলিশ মাছ কিনে বাসায় ফিরলাম।
কবে যেন আমার স্ত্রীর মুখে শুনেছিলাম, শ্বশুর আব্বার নাকি ইলিশ মাছ ভীষণ পচ্ছন্দের। দরজাটা খুলে আমার স্ত্রী আমায় দেখামাত্রই ভুবন ভুলানো একখানা হাসি দিলো৷ সারাদিন রোজা রেখে হাজারটা কাজ করা ঘাম জড়ানো ক্লান্ত মুখটা মুহুর্তেই যেন প্রানবন্ত হয়ে উঠলো। এমন টা যে আজকে প্রথম তা কিন্তু নয়। সে শত কাজের মাঝেও এই হাসিমুখটা নিয়েই রোজ দরজাটা খুলে দেয়। মেয়েটার এই দিকগুলো আমার বেশ ভালোই লাগে।
রমজান মাস এলেই আব্বা-আম্মা, বোনদের কথা খুব মনে পড়ে। ছোটোবেলার রমজান মাস বলতেই সোনালী স্মৃতি। যা হৃদয়ে দাগ কেটে রয় আজীবন। কত আনন্দ উল্লাস করতাম আমরা তিন ভাইবোন। বড় আপা আম্মার হাতে হাতে ইফতারি বানাতো। আমি আর ছোট বোন মিলে আব্বার আঙ্গুল ধরে মোড়ের দোকানে জিলিপী কিনতে যেতাম। এই জিলিপী নিয়েও কত তর্কাতর্কি যে হতো। বড় আপা জিলিপী দিয়ে মুড়ি মাখানো খেতে পারতো না। আর আমার ছোটো বোন আয়শা ওর খুব পচ্ছন্দ মুড়ির সাথে জিলিপী মাখানো। যখন ওরা দুই বোন এটা নিয়ে ঝগড়া শুরু করতো। আম্মা তখন সুন্দর করে দুইটা প্লেটে ভাগ ভাগ করে দুইজনের মন খুশি করে মুড়ি মাখিয়ে দিতো। আমি আবার সব খেতাম। যার জন্য আমার বোনরা আমায় পেটুক বলে রাগাতো। আব্বা তখন হাসতে হাসতে বলতো,
আমার দুই রাজকন্যা আর একটাই রাজপুত্র। আর রাজপুত্রতো একটু আধটু পেটুক হবেই। নইলে এতো সম্পত্তি কে খাবে আর? হা হা হা।
আব্বার কথা শুনে তখন আমরা সবাই হেসে উঠতাম। সেই দিনগুলো আজ কোথায় হারিয়ে গেলো।
দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর আম্মা মারা যান। শেষ অবলম্বনটুকু ছিলো আব্বা। তিনিও এক মধ্য রাতে বুকে ব্যথা নিয়ে তিন ছেলে মেয়েকে এতিম করে চলে যান।
শুনছো?
-হুম বলো।
ইফতারের সময় হয়ে এলো। আমি মাছটা কেটে আসি, তুমি একটু বেলের শরবতটা তৈরি করে রাখো।
-ঠিকআছে করছি।
ইফতার টেবিলে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসলাম। বেলের শরবতটা তৈরি করার সময় হঠাৎ খেয়াল হলো, আজকে যদি আমার শ্বশুর আসবেই তাহলেতো ইফতারের পূর্বেই আসার কথা৷ রমজান মাসে মেহমানতো ইফতারের পর আসে না। আর সে যে আসবে সেই কথাটাওতো আমার স্ত্রী আমায় এখনো পর্যন্ত বলেনি৷ বিকালের দিকে শুধু কল করে বললো একটা ইলিশ মাছ আনতে৷ আমিও ভেবে নিলাম হয়তো আমার শ্বশুর আসবে৷ আবার এখন দেখছি টেবিল ভর্তি সাজানো আছে নানান ধরনের ইফতারি। আমার ভাবনায় ছেদ পড়লো বাইরে কলিংবেলের আওয়াজে। দরজাটা খুলতেই দেখলাম আমার দুই বোন, বোনদের ছেলে-মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে। সবার মুখে মিষ্টি একটা হাসির রেখা। এভাবে সবাইকে একসাথে দেখে আমিও ফিক করে হেসে উঠলাম। আমার ছোটো বোন আয়শা বললো,
-কিগো ভাইয়া, আমাদের দাওয়াত করে এখন এমন ভাবে দেখছো যেন তুমি কিছুই জানো না?
আয়শার কথা শুনে আমি কি বলবো সেটাই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বড় আপা আমায় চুপ থাকতে দেখে বলে উঠলো,
-কি রে ভাই রোজা লেগে গেছে নাকি তোর? ছোটবেলায়তো রোজা লাগলেই এমন চুপ করে বসে থাকতি। আব্বা কত হাসানোর কথা বলতো। তুই সেই মুখ বন্ধ করে রাখতি আর বলতিস,
'আহ তোমরা চুপ করোতো, বেশি কথা বললে শয়তান মুখে ঢুকে যায় আর রোজা ভেঙ্গে যায়'।
আমরা তোর কথা শুনে খিলখিলিয়ে হেসে উঠতাম। আজ সেই ভাইটা কত বড় হয়ে গেছে। বাবার দায়িত্বটাও নিজের কাধে তুলে নিয়েছে।
.
ইফতারের টেবিলে বসে সবাই দোয়া পড়ছি। খেয়াল করলাম আমার স্ত্রী আশে পাশে কোথাও নেই। একটু পরই ও কিচেন থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে আসলো৷ হাতে রাখা বাটিটা আমার সামনে এনে রাখলো৷ দেখলাম বেশি করে দুধ দিয়ে রান্না করা সেমাই। আমি কিছু বলার আগেই বড় আপা বললো জানিসতো ভাই, তোর বউটা কিন্তু তোর খুব খেয়াল রাখে। মাঝেমধ্যেই আমায় কল করে শোনে তুই কি পচ্ছন্দ করিস, কি অপচ্ছন্দ করিস সে সবকিছুই।
মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনের মধুর কন্ঠে অন্তর শীতল করা আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। খেজুর মুখে নিয়ে ইফতার করছি আর মনে মনে বলছি, আমার স্ত্রী শুধু আমার খেয়ালই রাখে নারে আপা। ও যে তোদেরও কতটা খেয়াল রাখে তা আজ তোরা না আসলে আমিও জানতাম না। শুধু আমিই হয়তো ওর সঠিক খেয়ালটা রাখতে পারি না। ওর কি পচ্ছন্দ কি অপচ্ছন্দ, ওর কাজে সাহায্য করা কোনোটাই করি না। আজকে যখন এতোটা সামনে থেকে ওর কাজগুলো দেখলাম তখনিই এটা আরো বেশি করে উপলব্ধি করলাম৷
রাতে তারাবী নামাজ পড়ে এসে বিছানায় বসে আছি। আমার স্ত্রী তখনও নামাজে বসা। কিছুক্ষণ পর ও মোনাজাত শেষ করে কোরআন শরিফটা খুলে তেলওয়াত করতে লাগলো। আমি মুগ্ধ হয়ে সেই তেলওয়াত শুনতে থাকলাম।
এই মেয়েটাকে যত দেখি ততোই মুগ্ধ হই।
নাহ সে খুব রূপবতী নয়, তবে তার গুনের বাহার শতবার করেও শেষ করা যাবে না।
Comments (0)