বন্ধু বান্ধব নিয়ে চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছি।
সবাই অফিস শেষ করে এসেছে। আবার কিছুক্ষনের মধ্যেই সবাইকে ফিরতে হবে যার যার বাসায়।
এটা আমাদের প্রতিদিনের দেখা করার জায়গা। অফিস শেষ করে বাসায় যাওয়ার সময় মেইন রোডে দোকানটা পড়ে। বাড়ি ফেরার পথে কিছুক্ষন এখানে বসি। সারাদিনের ক্লান্তি আড্ডায় অনেকটা দূর হয়ে যায়।
সবার বাসা মোটামুটি কাছাকাছি। মেইনরোড থেকে ভেতরের দিকে। অফিস থেকে এসে নামা হয় মেইনরোডে। তাই এ জায়গাটাই বেছে নেওয়া।
রাস্তার পাশের চিরাচরিত চায়ের দোকান। শুধু দোকানের সামনে কয়েকটা বেঞ্চ আর চেয়ার পাতা। যেখানে বসে আকাশ দেখতে দেখতে আড্ডা দেয়া যায়।
সেদিনও আড্ডা চলছিলো। চা কয়েক কাপ খাওয়া শেষ। তুমুল আড্ডা চলছে। এ সময় একটা লোক উদভ্রান্তের মতো দোকানে ঢুকলো। লোকটার গায়ে কোন কাপড় নেই।
সবাই অবাক হয়ে গেলাম লোকটাকে দেখে। লোকটা সোজা এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়ালো দোকানের সামনে রাখা বিস্কুটের বয়ামের দিকে। দোকানদার হাঁ হাঁ করে উঠলো। তাড়িয়ে দেয়ার জন্য লাঠি নিয়ে তেড়ে এলো। লোকটা ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলো একটু।
দোকানদার লাঠি হাতে মারার ভংগি করে লোকটাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। লোকটা কিছু বলছে না। তার চোখের দৃষ্টি শূণ্য। সম্ভবত সে কথা বলতে পারে না।
চারপাশে জটলা বেঁধে গেছে। আমরা অল্পে উত্তেজিত হই। লোকটাকে আগে কখনো এখানকার লোকজন এখানে দেখেনি। ক্রমাগত আশেপাশের লোকজনের গলার আওয়াজ বাড়ছে। নানারকম ধারণায় তারা লোকটাকে বিচার করছে। প্রথমে তারা তাকে পাগল ভেবেছিলো, এখন ভাবছে চোর। অবস্থা এমন একটা পর্যায়ে চলে গেলো, যে কোন মূহুর্তে লোকটা এখন গণপিটুনির শিকার হতে পারে।
আমরা আড্ডা থামিয়ে লোকটাকে দেখছি। সে কিছুই বলছে না। হাত নাড়িয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছে। একবার আমাদের দিকে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো।
এধরনের ঘটনায় প্রায়ই গণপিটুনিতে লোক মারা যায়। কনফিউশনে নিরীহ মানুষগুলো দানব হয়ে যায়। ফ্রাস্টেশন অথবা জিদ যাই বলি না কেন, সব ঝেড়ে দেয় যাকে মারা হয় তার উপর। গণপিটুনিতে অনেক মৃত্যুর ঘটনা দেখেছি। আমি প্রচন্ডভাবেই এর বিপক্ষে। দোষী-নির্দোষ বিচারের জন্য আইন আদালত আছে, নিজের হাতে আইন তুলে নেয়ার মানে হয় না।
এদিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাচ্ছে। জটলা আরো বড় হয়ে গেছে। আমি আর থাকতে পারলাম না। উঠে দাঁড়াচ্ছি, এমন সময় আমার এক বন্ধু বললো, "কোথায় যাচ্ছিস? কি দরকার ঝামেলায় যাবার!"
আমি শুধু ঘুরে তাকে বললাম, তুই একটা ফোন দে পুলিশের হটলাইনে। বলেই ছুটলাম জটলার দিকে।
আমার সাথে এক-দুজন ছাড়া আমার বাকি বন্ধুরাও উঠে এলো। একা হয়তো তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না।
আমরা গিয়ে থামানোর চেষ্টা করলাম সবাইকে। মানুষ এতটাই উত্তেজিত হয়ে গিয়েছে, তারা পারলে আমাদেরই তখন মারে। এসময় আমার পেছনে থাকা বন্ধুটি এগিয়ে এসে বললো, "পুলিশ আসছে, এখন মারামারি করলে পরে সবাইকে ধরে নিয়ে যাবে।"
সব জিদ যেন কর্পূরের মতো উবে গেলো। মূহুর্তে ভিড় কমতে শুরু করলো। পুলিশের নাম শুনেই সবাই চলে যাচ্ছে। আমি দোকানদারকে বললাম একটা কাগজে কয়েকটা বিস্কুট আর পানির বোতল দিতে।
ওর দোকানে একটা গামছাও ছিলো, সেটাও চাইলাম। খুব অনিচ্ছায় আমার কথাগুলো পালন করলো সে।
লোকটাকে আমরা গামছা পেঁচিয়ে দিলাম। নিয়ে এলাম আমরা যেখানে বসেছিলাম সেখানে। তার সামনে দেয়ামাত্রই সে বিস্কুট খাওয়া শুরু করলো। পানির বোতল খুলে দিলাম। সে এমনভাবে পানি খাচ্ছে যেন বহুদিন তৃষিত ছিলো কোন মরুভূমিতে।
আমরা তাকে ঘিরে বসে আছি। অবাক হয়ে দেখছি।
পুলিশ আসছে পাশের থানা থেকে। জটলাটা এখনো যায়নি, এখন তারা দাঁড়িয়েছে আমাদের ঘিরে। সবাই লোকটাকে দেখছে। সে মাটিতে বসে বিস্কুট খাচ্ছে।
আমরা নিজেরা কথা বলছি।
"আমার কাছে মনে হয় না লোকটা পাগল অথবা চোর। তার স্বাস্থ্য বা চেহারা দেখে এমন মনে হচ্ছে না। অজ্ঞান পার্টি বা কিডন্যাপিং এর শিকার হতে পারে কি?"
এই কথা বলার সাথে সাথে সিচুয়েশন পাল্টে গেলো।
সবাই এখন মনোযোগ দিয়ে লোকটাকে দেখছে। আসলে কেউই এতক্ষন ভালোমতো দেখেনি। লোকটার স্বাস্থ্য ভালো, চেহারার মধ্যেও একটা ভালোমানুষের ছাপ আছে। তাকে দেখেও মনে হয় শিক্ষিত।
আমার বন্ধুরা একমত হলো আমার সাথে। তারপর জটলা করে থাকা লোকগুলোও। রাগ বদলে গেলো সিমপ্যাথিতে। লাঠি নিয়ে তেড়ে আসা দোকানদার ভাই আরো কয়েকটা বিস্কুট কাগজে করে দিয়ে গেলো লোকটার সামনে।
আসলে মেইনরোডে অজ্ঞান পার্টির শিকার হয়ে ফেলে যাওয়া বিচিত্র না। বাসে উঠলে একটা চক্র থাকে, অজ্ঞান করে সব হাতিয়ে নেয়, তারপর ফেলে যায় মেইনরোডে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ওষুধের প্রভাবে অনেকটা সময় পর্যন্ত ভিক্টিমের হুঁশ থাকেনা, বা কথা বলতে পারে না। আমার বলা কথাগুলোই এখন বিভিন্নভাবে ফিরে আসছে যুক্তি হয়ে। সবাই এখন মমতাভরে লোকটার বিস্কুট খাওয়া দেখছে।
এর মধ্যে পুলিশের টহল গাড়ি চলে এলো। আমরা ঘটনা বললাম। তারাও একমত হলো আমাদের সাথে। লোকটার চিকিৎসা দরকার খুব তাড়াতাড়ি। লোকটাকে নিয়ে চলে গেলো তারা।
যাওয়ার সময় লোকটা সবাইকে দেখে গেলো। দেখে গেলো মানে দৃষ্টি বুলিয়ে গেলো। তার দৃষ্টি তখনও শূন্য।
আমরা চলে এলাম বাসায়। সেরাতে ঘুমোতে গিয়ে বারবার মনে হচ্ছিলো, এমন তো যে কারো সাথে হতে পারে। একদিন আমিও তো এমন বিপদে পড়ে পাগলের বেশে রাস্তায় আটকে যেতে পারি। তখন মানুষ আমাকে পিটিয়ে মেরে ফেললেও তো আমার করার কিছু থাকবে না।
তারপর দিন আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে থানায় গিয়েছিলাম। আমরা সেই লোকটির কথা জানতে চাইলাম। ডিউটি অফিসার খুব খাতির করে আমাদের বসালেন।
আমাদের ধারণাই ঠিক ছিলো। লোকটি অজ্ঞান পার্টির শিকার হয়েছিলো। তার কাছ থেকে সবকিছু নিয়ে তাকে তারা ফেলে দেয় রাস্তার পাশে।
পুলিশ তাকে সরকারী হাসপাতালে ভর্তি করে। আস্তে আস্তে ওষুধের প্রভাব কেটে যাওয়ার পর তিনি নিজেই পুলিশকে সব বলেছেন, তার পরিচয় দিয়েছেন। তার বাসার লোকজনও এতক্ষনে চলে এসেছে হাসপাতালে। তিনি এখন ভালো আছেন।
"আপনারা তো দারুণ কাজ করেছেন রে ভাই।
জীবন বাঁচিয়ে দিয়েছেন তার। শরীরের ওই অবস্থায় গণপিটুনি খেলে মরেই যেতো লোকটা।"
ডিউটি অফিসার বললেন।
আমরা একটু হেসে চলে আসার জন্য উঠলাম।
"দেখা করবেন না! ওমা! তিনি যে বলেছিলেন আপনাদের কথা। বললেন তাকে কয়েকটা ছেলে বিস্কুট খাইয়েছিলো। চলুন দেখা করে আসি।
পুলিশের গাড়িতে করে পৌঁছে দেবো আপনাদের।"
আমি মাথা নিচু করে আছি। আমার দেখা করতে যাওয়ার ইচ্ছা তেমন একটা নেই। আমার বন্ধুরা আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
দেখা হয়নি সেদিন ভদ্রলোকের সাথে। আমরা চলে এসেছিলাম। আমি তাকে বিরক্ত করতে চাই নি।
কে জীবন বাঁচিয়েছে সেটা বড় কথা না, একজনের জীবন বেঁচে গেছে এটাই বড় কথা।
সেই একজনের কাছে, তার পরিবারের কাছে এর মূল্য অপরিসীম।
অধিকার নেই আমাদের কারো জীবন নেয়ার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেয়ার।
-পিয়াস মাহবুব খান
Comments (0)