Search

ছোটগল্পঃ জ্বর

  • Share this:

বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমার বৃদ্ধ বাবা তার নাতি-নাতীদের গল্প শোনাচ্ছেন I পাশের ঘর থেকে আমি শুনছি উনি বলছেন, আমার ছোটবেলায় প্রায় প্রতিবছরই আমার জ্বর হতো আর জ্বর হলে আমার বাবা শহর থেকে পাউরুটি, কলা আর গ্লুকোজ এর প্যাকেট নিয়ে আসতেন I তিতা মুখে কি আর খাওয়া যায় ? সব খাবার গুলি আমার বিছানার শিওরে রেখে দিতাম l কেউ যেন নিতে না পারে I শর্তসাপেক্ষে বড় ভাইকে অল্প অল্প করে দিতাম কিন্তু যখন জ্বর সেরে গিয়ে মুখে রুচি আসত তখন খাদ্য গুলি আর খাবারের উপযুক্ত থাকত না l

কসম কেটে আমার বড় ভাইকে দিতাম এই বলে যে, যদি তোমার জ্বর হয়! তখন আমাকে শোধ করে দিবে কিন্তু l ভাইয়ের বড় দুঃখ ওর কখনো জ্বর হতো না l তাই ও পাউরুটি কলাও পেতো না l জ্বরের জন্য আমি খেতে পারতাম না l তাই ও মাঝেমধ্যে এসে একটু একটু করে চেয়ে নিত l আমার ভাই পাউরুটি কলা খুব পছন্দ করত l কিন্তু আফসোস ওর জ্বর হতো না l এই জন্য ওর মনে অনেক কষ্ট ছিল l

একবার আমি রাগ করে বলেছিলাম, তোমার জ্বর আসতে পারে না ? তুমি শুধু আমার খাবার গুলো খেয়ে নাও l সেদিন ও বলেছিল দেখে নিস আমারও একদিন অনেক বড় জ্বর হবে, সেদিন বাবা এত পাউরুটি কলা নিয়ে আসবে তুই খেয়ে শেষ করতে পারবি না l সেদিন একসঙ্গে তোর সব দেনা শোধ করে দেবো দেখিস l

এখন বৃদ্ধ হয়ে গেছি, এখন আর কেউ আমার জন্য কিছু নিয়ে আসে না I যদিওবা কেউ কিছু নিয়ে আসে, ডাক্তার বলে, এটা তোমার খাওয়া যাবে না, ওটা তোমার খাওয়া যাবে না I তখন আমার ছেলেমেয়েরা জিজ্ঞেস করে, নানাভাই তোমার কি পাউরুটি আর কলা খেতে ইচ্ছে করেছে ? আম্মুকে বলে আজ তোমার জন্য অনেক পাওয়া রুটি আর কলা কিনে নিয়ে আসব l বাবা জানালেন, খেতে ইচ্ছে করেই কিন্তু আমি যে আর পাউরুটি কলা খাইনা! কেন তুমি খাও না ? জিজ্ঞেস করলে উনি জানালেন l

একবার কি হলো, সেই বছর আমার আর জ্বর হয় না l তাই ভাইকে বললাম আমার তো জ্বর এলো না l ভাই, তোমার জ্বর হয় না কেন ? জ্বর না হলে, তো আর পাউরুটি কলা পাওয়া যাবে না I পাওয়া যাবেনা গ্লুকোজ এর প্যাকেট I তাহলে আমারা এবার পাউরুটি কলা খেতে পারব না ভাই ? ও বলেছিল আগামী শুক্রবার জুমার নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করব, জ্বর আসার জন্য আমার যেন অনেক বড় জ্বর হয় l অনেক অনেক বড় জ্বর হতে হবে l

আমাদের আত্মীয় স্বজনরা সবাই পাউরুটি কলা নিয়ে আমাকে দেখতে আসবে I আমিও যে কি বোকা! ওকে বলেছিলাম আল্লাহ যেন তোমার দোয়া কবুল করে l আমার মা প্রায়ই বলতেন নদীতে বেশি সময় ডুব দিবেনা, জ্বর এসে যাবে I তাই একদিন জ্বর আসার কামনায় বড় ভাই নদীতে সারাদিন গোসল করেছিল I আর আমি নদীর পাড়ে বসে বসে দেখেছিলাম l

অনেক সময় গোসল করার জন্য ভাইয়ের চোখ দুটি লাল হয়ে গিয়েছিল I আমার বাবা সেদিন ওকে লাঠি দিয়ে অনেক মেরেছিল I মা জিজ্ঞেস করলেন, কেন সারাদিন নদীতে গোসল করেছো তুমি ? বলেছি আমার শরীরে জ্বর আসার জন্য I মা জানিয়েছিলেন, অসুখ বিসুখ কামনা করা কোনো ভালো লক্ষণ না বাবা l তখন মাকে ভাই বলেছিল ছিল যে, শুধু জ্বর হলেই তো তোমরা পাওয়ারুটি, কলা, মাখন এনে দাও ! এমনিতে কি দাও ? তাই জ্বরের জন্য শুক্রবারে মসজিদে আল্লাহর কাছে দোয়া করছি I তার পরেও তো জ্বর এলো না, মা তাই আর সারাদিন গোসল করেছি l দেখে নিও মা, আজ রাত্রেই আমার অনেক জ্বর আসবে I

সবকিছু শুনে আমার কৃষক বাবা বিকালে থানার বাজার থেকে আমাদের সবার জন্য অনেক পাউরুটি , মাখন আর সাগর কলা নিয়ে এসেছিলেন I সেই রাত্রে আমরা দুই ভাই অনেক মজা করে অনেক পাউরুটি মাখন আর সাগর কলা খেয়েছিলাম l

পরের দিন সকালে আমার ভাই বিছানা থেকে আর উঠতে পারেনা l ওর শরীর অনেক গরম হয়ে গেছে l গ্রামের হোমিওপ্যাথি ডাক্তার এসে দেখে ওষুধ দিয়ে গেলেন I পাশের গ্রাম থেকে নিয়ে আসা হল বড় কবিরাজ কে l এখনো মনে পড়ে কবিরাজ আমার বাবা কে বলেছিলেন শিউলি ফুলের পাতার রস এবং কালো মেঘের পাতার রস সাত দিন খাওয়াতে হবে l কিন্তু কোনো কিছুতেই আমার ভাইয়া জ্বর সারে না l

জ্বর এতই বেশী যে , শেষে ওকে থানা হাসপাতালের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো I ডাক্তার অনেক ওষুধ দিলেন l প্রায় দুই সপ্তাহ হয়ে গেল ওর জ্বর সারে না l শুধু আমার মাকে বলতো, মা মাথাব্যথা করে , গলাব্যথা করে, পেটব্যথা করে, কিছুই খেতে পারে না, শরীর শুকুয়ে গেছে, কেউ গেলে শুধু তার দিকে তাকিয়ে থাকে, ঠিক ভাবে কথাও বলতে পারে না I প্রায় এক মাসের মত হয়ে গেল আমার ভাইয়ের জ্বর সারে না l একদিন সকালে দেখা গেল ওর শরীরে চামড়ায় ঘামাচির মত লালচে দানা। জেলা শহরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো l

জেলার বড় ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানালেন, আমার ভাইয়ের টাইফয়েডের জ্বর হয়েছে l ওকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া হলো l হাসপাতাল জেলা শহরে হওয়াতে ওকে আমি দেখতে পারি না l আমারও খুব খারাপ লাগে I বড় চাচাকে বললাম আমি ভাইকে দেখতে যাব l আপনি কি আমাকে নিয়ে যাবেন ? মা, বাবা তো সবসময় হাসপাতালেই থাকে কিন্তু খালি হাতে কিভাবে যাব ভাইকে দেখতে ? আমার সব সময় মনে হতো ওর অসুখের জন্য আমি নিজেই দোষী l কেন যে ওকে জ্বর আসার জন্য বলেছিলাম l মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম ও যখন বাড়িতে ফিরে আসবে তখন আমার গাবগাছের লাটিম টি ওকে দিয়ে দিব l যে লাটিম টি ছোট মামা আমাকে উপহার দিয়েছিল l

আমার বড় চাচা লক্ষ্মী পূজার মেলাতে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে, আমাদের দুভাই কে দুটি মাটির ব্যাংক কিনে দিয়ে ছিলেন I আমার ব্যাংকটি ভেঙে ফেললাম l ভেতরে দেখি অনেকগুলো পয়সা, পাঁচ টাকার মতো হবে l চাচাকে জানালাম এই পয়সাগুলো দিয়ে পাউরুটি আর সাগর কলা কিনতে হবে আমার ভাইয়ের জন্য l সেদিন পাউরুটি কলা কিনে হাসপাতালে গিয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু ওকে আর দেওয়ার ভাগ্য হয়নি l সেই দিন আনুমানিক সকাল দশটার দিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে, আমার একমাত্র বড় ভাই l ভাইয়ের লাশের পাশে বসে অনেক কেঁদেছিলাম আমি l আর সেই দিনের পর থেকে, আমি আর কখনো পাউরুটি আর কলা খাইনি l

 

লেখক: গোলাম রব প্রবাসী l

Tags:

About author
আমি গল্প এবং বই প্রেমিক একজন মানুষ। গল্প এবং বই পড়তে খুবই ভালোবাসি। যেখানেই যে গল্প অথবা কাহিনী খুজে পাই সেগুলো সংগ্রহ করি এবং আপনাদের সাথে শেয়ার করার চেষ্টা করি। আমি নিজেও কয়েকটি গল্প লিখেছি তবে সেগুলোর সংখ্যাটা খুবই সামান্য।