মা দিবসে মনের মাধুরি মিশিয়ে একটা রচনার মতো করে বিশাল একটা পোস্ট দিয়ে মাত্র উঠলাম। ইতিমধ্যেই বেশ লাইক ,কমেন্ট পড়েছে। উঠেই এক কাপ চায়ের জন্য চিৎকার করে উঠলাম ," এই সংসারে কি এক কাপ চা পাওয়া যাবে না কি?" আমার চিৎকার শুনে মিনিট ২ পরে এক কাপ চা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মা বলল,"এই নে বাবা তোর চা "। চা টা মুখে দিয়েই মেজাজ একেবারে চড়ক গাছে উঠে গেছে ! " চায়ের মধ্যে আদা কেন দিছো ? আমি তোমায় বলেছি আদা দিতে ? এত মাতবারি কই পাইছো ? এক কাপ চাও বানাতে পারো না ,জীবনে কি করেছো ? " শ'খানেক ধমক দিয়ে কথাগুলো মাকে বলে চায়ের কাপটা ঠাস করে টেবিলে রাখলাম । খুব বড় অপরাধ করেছে এমন মুখ করে মা আমায় বলল ,"মাফ কর বাবা ,আসলে তুই তো ১০ মিনিট আগে বললি তোর মাথাটা ধরেছে তাই ভাবলাম আদা চা করলে তোর যদি একটু ভাল লাগে ,তুই রাগ করিস না বাবা আমায় কাপটা দে আমি নতুন করে চা করে নিয়ে আসি ! " " আর লাগবে না ,শখ মিটে গেছে" বলে বিড়বিড় করতে লাগলাম। মা ভয়ে ভয়ে কাপটা টেবিলের থেকে নিয়ে চলে গেলো।
মিনিট পাঁচেক পরে রান্নাঘর থেকে কিছু ভাঙার শব্দ শুনে দৌড়ে গেলাম। গিয়ে দেখি আমার এতো সাধের আমেরিকা থেকে আনা কাপটা ভেঙে নিচে পড়ে আছে। কাপটা বন্ধু আমার জন্য আমেরিকা থেকে এনেছিল ,এতো সাধের কাপটা ভেঙে যাওয়ায় আমি খুব রেগে গেলাম ," তোমায় কে বলেছে পন্ডিতি করতে? দিলে তো আমার শখের কাপটা ভেঙে। তুমি না কোন কাজের এই না ,বসে বসে অন্ন ধ্বংস করছ শুধু। আর মোহনাকেও এখনি মার্কেট করতে যেতে হলো ,বিরক্ত। " আমি রান্না ঘর থেকে আবার বিড়বিড় করতে করতে বের হলাম। খেয়াল করলাম ফ্লোরটা গরম ছিল যেখানে চায়ের ক্যাপটা ভেঙেছে তারমানে গরম চা ছিল তাতে। আমি কথাগুলো বলার সময় মা হাতটা শাড়ির আঁচলে লুকিয়েছিল ,হয়তো হাত পুড়েছে। তাতে আমার কি কে বলেছে পন্ডিতি করতে। মুডটা ফ্রেশ করতে বাইরে বের হলাম টং এর দোকানে চা খেতে।
সরকারি চাকরি করি ভাল পোস্টে যার কারণে এই এলাকার সবাই আমায় খুব ভাল করে চেনে। বেশ কষ্ট করে এতোদূর এসেছি ,বাপ মরা ছেলে হলে যা হয়। কম কাঠ খড় পোড়াতে হয়নি এতোদূর আসতে। কি এই বা ছিল ভাঙা একটা ঘর আর চাষের ওই ৫ কাঠা জমি ছাড়া। আজ আমার ৩ তলা বিল্ডিং ,নিজস্ব গাড়ি আছে ,দারোয়ানও রাখা। কোথায়ও গেলে সবাই চেয়ারটা ছেড়ে দেয়। বড়লোকের একমাত্র মেয়েকেও বিয়ে করেছি কি আর চাই আমার। করিম ভাইকে একটা স্পেশাল চায়ের অর্ডার করে আরাম করে বেঞ্চিটাতে বসলাম। "স্যার ১০ টা টেহা দেন না ,একটা ফুল কিনুম " ৯ বছরের একটা ছেলে আমার দিকে তাকিয়ে কথাটা বলছে।
- কি করবি টাকা দিয়ে?
- ফুল কিনুম
- কার জন্য ?
- মায়েরে দিমু ,আইজ নাকি মা দিবস?বেবাকে কয়। আইচ্ছা স্যার কন দি মায়েগো কি আলাদা দিবস ওয়? হগল দিন এই তো মা দিবস ঠিক না কন?
-তো ফুল কেন কিনবি ?
- মায়েরে দিমু ,আর কমু মা তোমারে ভালবাসি।
- এসব ন্যাকামো করিস না তো ! মা কে আবার ফুল দিতে হবে কেন শুনি ? তোর মা তো তোর জন্য কিছু করেনি ,করলে তুই আজ ভিক্ষা করতি না। আসছে ফুল দিতে মা কে , যত সব আদিক্ষেতা। যা তো এখান থেকে যা
- বুজ্জি ,আপনি স্যার মানুষ না
- মানুষ না মানে?
"আপনি অমানুষ এট্টা" বলেই ছেলেটা দৌড় দিল। আমি শুনতে পেলাম যেতে যেতে ছেলেটা আমায় শ'খানেক গালি আর অভিশাপ দিয়ে গেলো। এই জন্যই এসব লোকদের আমার কাছে ঘেষতে দিতে ইচ্ছে করে না ,কি মুখের ভাষার শ্রী। শুনলেই বমি পায়।
চায়ের বিলটা মিটিয়ে আশরাফ কে কল করলাম ,বেশ কিছুদিন হলো ওর সাথে কথা হয়না। কল করে ওকে দেখা করে আসতে বললাম। ওর বাসা আমার বাসার প্রায় কাছেই। মিনিট ১০ পড়ে আশরাফ চলে এলো
- কিরে শালা কেমন আছি ?
- এই তো আছি কোন রকম ,আম্মাকে নিয়ে একটু চিন্তায় আছি রে।
- কেন আন্টির আবার কি হলো ?
- জানিস এই তো আম্মার শরীরটা ভাল নেই ,মাস ২ হলো বিদেশ থেকে বড় একটা অপারেশন করিয়ে নিয়ে এলাম ,বেশ খরচ পড়ল। এখনো পুরোটা সুস্থ হয়নি ,রোজ অনেক টাকার ওষুধ লাগে। মাকে দেখার জন্য একটা লোকও লাগে। ইমা তো প্রেগন্যান্ট জানিস এই ওর কষ্ট হয়ে যায় ,বুঝতে পারছি না কি করব।
- আমি তো তোকে বলেছিলাম এই বিদেশ গিয়ে এতো খরচ করে অপারেশনটা করাস না ,বাংলাদেশে কত ভাল ডাক্তার আছে তাই দেখালেই হতো। তুই কথা শুনলি না। হায়াত যতদিন আছে বাঁচবে এতে এতো খরচের কি আছে। নিজের অবস্থাটাও খারাপ করে ফেলেছিস।
- মায়ের প্রতি আমার ভালবাসা আছে দায়িত্ব আছে সেই তুলনায় টাকা কিছুই না। আম্মাকে বাঁচিয়ে রাখতে যদি আমার সর্বস্ব বিক্রি করতে হয় আমি তাই করব। জীবনটা তো আমার জন্যই উৎসর্গ করল ,এখন তার প্রতিদান স্বরুপ এটুকু আমায় করতেই হবে। নতুবা মনুষ্যত্ব বলে কিছু থাকবে না।
- সন্তান জন্ম দিলে তাদের দায়িত্ব তো পালন করবেই। এই বয়সে এতো ঝামেলা নেওয়ার কি আছে বল তো ? আর কি এই বা করেছে আমাদের জন্য ,ভাল একটা জীবনও দিতে পারে নি। কষ্ট তো আমরা করে মানুষ হয়েছি। তারা তাদের দায়িত্ব পালন করেছে ,এখন আমাদের দায়িত্ব তাদের খাওয়ানো ,থাকার জায়গা দেওয়া ,ব্যাস।
আমার কথা শুনে আশরাফ মুচকি হেসে বলল " চল আমার সাথে। " বলেই হাতটা ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেলো ওর সাথে।
আশরাফের বাসায় গিয়ে দেখি ওর প্রেগন্যান্ট বউ ঘর ঝাড় দিচ্ছে ,পাশে ওর মা শুয়ে আছে। বিষয়টা আমার খুব খারাপ লাগল ,আমি আশরাফকে বললাম ,
- ভাবী এই অবস্থায় ঝাড়ু কেন দিচ্ছে ,এখন তো নিচু হওয়া বারণ তাই না ? তুই একটা কাজের মেয়ে রাখলেই পারিস। আন্টিও তো একটু হেল্প করতে পারে তাই না ?
আমার কথাশুনে আশরাফ মুচকি হেসে বলল ," এটা দেখেই তুই এতোটা কষ্ট পাচ্ছিস ,একটাবার ভেবেছিস তোর মাও তোকে পেটে নিয়ে এর থেকেও বেশি কাজ করেছে। আরে তোদের তো ভাঙা মাটির ঘর ছিল সেখানটায় তোকে নিয়ে থাকতে তার কতোটা কষ্ট হয়েছে ? তোর বাবা তো তোর জন্মের ৩ মাস পরই মারা গেলো ,এরপর তোর মা একা কি করে তোকে মানুষ করেছে ? সংসার সামলিয়েছে। কখনো তার মুখে কষ্টের ঝাপ দেখতে পেয়েছিলি ? তোকে কষ্ট বুঝতে দিয়েছিল বল? তোকে তো কখনো বুঝতেও দেয় নি সে কি করে তোর ভরণ পোষন চালাচ্ছে ? এই মায়ের জন্য কি শুধুমাত্র ৩ বেলা খাবার আর থাকার জায়গা দিলেই সব দায় শেষ ? এটাকে দায় বলাও ভুল এটা তোর কর্তব্য ! শুধুমাত্র আজ আমার স্ত্রী ঝাড় দিয়েছে ,রোজ মা এই এসব করে। এখনো সময় আছে মা কে সন্মান কর,তিনি তোকে পেটে না ধরলে তোর এতো গর্ব কোথা থেকে আসত বল ?
আশরাফের করা প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে আমি ওর বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। আমি বাসায় যাচ্ছি ৫ মিনিটের পথ যেন ফুরাচ্ছেই না। দৌড়ে বাসায় গিয়ে ১ বার বেল দিতেই মা দরজা খুলল ,আমার ইচ্ছে করছিল মাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদি আর ক্ষমা চাই ,কিন্তু আমার মত নেমকহারামের কোন যোগ্যতা নেই মাকে জড়িয়ে ধরার। আমি মায়ের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম আর নিজের কর্মের জন্য ক্ষমা চাইতে লাগলাম,আমি জানি আমি যা করেছি তার জন্য আমায় কেউ মাফ করবে না। মা আমায় তুলে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,"কি হইছে বাবা? কাঁদছিস কেন? শরীর খারাপ ,কেউ বলেছে কিছু বল আমায়? পায়ে কেন পরছিস ? তুই তো আমার চোখের মণি। " মায়ের কথার কোন জবাব নেই আমার কাছে ,আমি ঢুকরে ঢুকরে আরও বেশি কাঁদছি একটা বাচ্চা ছেলের মতো যেমনটা আমি ৭ বছর বয়সে ব্যথা পেলে কাঁদতাম।
বেশ কিছুক্ষণ পরে আমি একটু স্বাভাবিক হয়ে মা কে বললাম ," মা আমার মাথাটা ধরেছে একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে ? " আমার কথা শুনে মা আমার দিকে তাকিয়ে কান্না করে দিলো। আমার হাতটা ধরে তার রুমে নিয়ে গিয়ে কোলে শুইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। আমি এতোটা প্রশান্তি আগে কখনো অনুভব করিনি ,যতোটা আজ মনে হচ্ছে। জানি না কখন মায়ের কোলেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছি। প্রায় ২ ঘন্টা পর ঘুম ভাঙলে দেখি আমি তখনো মায়ের কোলল মাথা রেখে শুয়ে আছি আর মা আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি জেগে উঠতেই মা বলল," মাথা ধরা কমেছে বাবা?" আমি হ্যাঁ সূচক জবাব দিয়ে মাকে বললাম রেডি হও একটু বের হবো।
২০ মিনিট পরে মা কে নিয়ে চলে এলাম নিকটস্থ সবথেকে দামী রেস্টুরেন্ট এ। মা কে শক্ত হাতে ধরে নিয়ে এলাম রেস্টুরেন্ট এর ভিতরে। ওয়েটার খাবারের মেনু নিয়ে এলেই আমি মা কে বললাম,
- কি খাবে মা ?
- তুই বল বাবা,আমি তো এসব বুঝি না। তুই যা খাওয়াবি তাই খাব। কিন্তু বাবা এতো দামী রেস্টুরেন্ট এ কেন এলি আমায় নিয়ে? এতো খরচ কি ঠিক হবে? তুই বৌমাকে নিয়ে এলেই পারতি। আমি তো ঘরেই ভাল খাই।
- মুচকি হেসে বললাম ,মেনু ছাড়াই বল কি খাবে ?
মা খানিকটা আমতা আমতা করে বলল," ডিমওয়ালা ইলিশ পাওয়া যায় এখানে? আর ঝাল ঝাল খাসির গোশ ?"
মায়ের কথা শুনে আমি বেশ চমকে উঠলাম। এমনটা না যে আমার ঘরে এসব রান্না হয়না। কিন্তু মা কে কখনো খেতে দেখিনি এসব। অবশ্য মায়ের সাথে বসে খাওয়ার ফুরসত কই আমার। তবুও যতটা দিন দেখেছি মা এসব কখনো খায় নি ,আমাদের বাসায় খাশির গোশ রান্না হলে কিছুটা মিষ্টি দেওয়া হতো ,আমি পছন্দ করি বলে।
আমি খাবারগুলো অর্ডার করে বসে আছি ! ১০ মিনিটেই খাবার হাজির হলো সামনে। বাটিতে করে সব দেওয়া আছে,প্লেটে ভাত আর একপাশে ২ টা চামচ। আমি মা কে খেতে বলে,নিজে খাওয়া শুরু করলাম। মা দেখি চামচ নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। আমি বিষয়টা বুঝতে পেরে চামচ রেখে হাত দিয়ে খেতে শুরু করলাম। আমায় দেখে মাও তাই অনুকরণ করল !
" আচ্ছা মা,তুমিতো ইলিশ খাও না,তবে আজ কেন?" প্রশ্নটা করে মায়ের দিকে তাকালাম ! " আসলে ইলিশ মাছে খুব কাঁটা থাকে বেছে খেতে পারি না তাই খাই না। " মা খানিকটা লজ্জা নিয়ে কথাটা বলল যেন সে বড় ভুল করেছে ! আমি বাটি থেকে ইলিশ মাছের পিছটা তুলে কাঁটা বেছে মায়ের মুখে তুলে দিলাম। মা হা করে খাচ্ছে তা ,খেয়াল করলাম মায়ের প্লেটে কিছুটা ডাল জমা হচ্ছে যার রং টা একদম পানির মত। আমি বুঝতে পারছি মা কাঁদছে ,তবে এটা হয়তো পরম প্রাপ্তির কান্না ! আমি ফোনটা হাতে নিলাম একটা ছবি করে পোস্ট করব বলে,কিভেবে যেন ফোনটা রেখে দিলাম। জীবনে তো মনুষ্যত্বের কিছুই রাখিনি। পুরো জীবনটায় শুধু শো অফ করে গেলাম। ফোনটা রেখে মা কে নিজের হাতে খাইয়ে দিলাম। আজ এই প্রথম নিজেকে মানুষ বলে মনে হচ্ছে।
Poly Talukder
Comments (0)