১
দড়াটানা, যশোর শহরের প্রান কেন্দ্র। যশোরের সবচেয়ে ব্যস্ত এলাকা এই দড়াটানা। আর দড়াটানার সবচেয়ে ব্যস্ত স্পট হল লীলা প্লাজা। শপিং মল, রেস্টুরেন্ট, ব্যাংক, গার্মেন্টস নিয়ে স্বগর্বে দড়াটানায় দাঁড়িয়ে আছে নয় তলার এই ভবন। কিন্তু সকাল ১০ টার দিকে নিচের তলার রেস্টুরেন্ট এর সিলিন্ডার বিষ্ফোরনের মাধ্যমে সৃষ্ট আগুন এখন ভয়াবহ রুপ নিয়েছে। আগুন নিয়ন্ত্রনে কাজ করছে ফারার সার্ভিসের ২৩ টি ইউনিট।
------------------------------
-লাল সবুজের এই পতাকাকে সব সময় উড়তে দেখার স্বপ্ন সব বাঙ্গালীই দেখেন কিন্তু এই পতাকাকে উড়িয়ে রাখার দায়িত্ব কিন্তু আমাদের। ইতিহাসের প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যে গৌরবময় ভূমিকা রেখেছে তার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে যদি কখনো নিজের জীবন ও দিতে হয় তার জন্য আমি সবসময় প্রস্তুত, তোমরা কি প্রস্তুত..?
-ইয়েস স্যার..!
-আই ক্যান্ট হেয়ার..!
-ইয়েস স্যার...!
নতুন সেনাসদস্য দের নিজের দায়িত্ব এবং দেশপ্রেম নিয়ে এতসময় কথা বললেন ক্যাপ্টেন আতিকুল ইসলাম কাব্য, যিনি যশোর ক্যান্টনমেন্টে ক্যাপ্টেন কাব্য নামেই বেশি পরিচিত। নিজের কথা শেষ করে ঘুরে দাঁড়ানো মাত্রই তাকে জরুরি ভাবে ডাকা হল অফিসে। অফিসে গিয়ে সিনিয়র অফিসার রাজুর সামনে দাঁড়িয়ে বলে
-ক্যাপ্টেন কাব্য রিপোর্টিং স্যার..!
-ক্যাপ্টেন কাব্য..?
-ইয়েস স্যার..!
-লীলাপ্লাজায় আগুন লেগেছে, ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে আমাদের সাহায্য চাওয়া হয়েছে। আমি আর আপনি যাচ্ছি সেখানে উইথ আওয়ার ফোর্স..!
-ওকে স্যার..।
২
-আপনার অফিসে কোন মন্ত্রী আসতে চাইলেও আপনার অনুমতি নিয়ে আসতে হয়, কিন্তু আমি কারো অনুমতি না নিয়েই চলে এসেছি, তাহলে আমার ক্ষমতা কতটুকু তার আচ হয়ত আপনি করতে পারছেন মেজর..!
ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ এবং যশোরের সব থেকে প্রভাবশালী নেতার কথা শুনে নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ান মেজর হাসান হায়দার। তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রনের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছেন যাতে তিনি রেগে না যান। অন্যদিকে সাংসদ জাহিদ কোন উত্তর না পেয়ে আবার বলেন
-একটু ভেবে দেখুন মেজর..!
-আমার ভাবা হয়ে গেছে..
-কি ভাবলেন..?
-আপনি যদি ২ মিনিটের মধ্যে না যান তাহলে আমাকে ব্যবস্থা নিতে হবে...!
যশোরের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা এতবড় অপমান নিতে পারলেন না। মেজর হাসানের টেবিলে চড় দিয়ে বলেন
-এত সাহস কোথায় পান...?
-এটা আপনার সংসদ না মিঃ জাহিদ, এটা ক্যান্টনমেন্ট..
এইটুকু বলে একটু থামেন তিনি থেমে এবার নিজের ইউনিফর্মের উপর হাত দিয়ে বলেন
-এটাই আমাকে দেয় এত সাহস..! বুঝেছেন..? এখন আপনি যেতে পারেন..!
চেয়ার ছেড়ে উঠে যেতে যেতে জাহিদ বলে
-আঙ্গুল তাহলে বাঁকাতে হবে...!
---------------------------------------------
জাহিদ যাওয়ার পর হাসান নিজের টেবিলের উপর থাকা গ্লাস হাতে নিয়ে পানি খেলেন। খালি পানির গ্লাসটা টেবিলে রেখে তিনি দায়িত্বে থাকা সৈনিককে বলেন
-সোলজার..?
-ইয়েস স্যার..!
-ক্যাপ্টেন কাব্যকে দেখা করতে বল
-ইয়েস স্যার...!
৩
লীলাপ্লাজার আগুন কোন ভাবেই নিয়ন্ত্রনে আসছে না। সকল সৈনিক আপ্রান চেষ্টা করে যাচ্ছে আগুন থেকে সাধারণ জনগণ কে বাচাতে। কিন্তু এই মুহুর্তে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়েছে লীলাপ্লাজার ৬ এবং ৭ নম্বর তলা। এই দুইটি তলায় একটি গার্মেন্টস আর সেখানে প্রায় ১৫০০-২০০০ কর্মী রয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের অফিসার এসে কর্নেল রাজুকে বলেন
-স্যার, আগুন নিয়ন্ত্রন সম্ভব না। সবাই কে উদ্ধার করতে হবে..!
-আগুন না নিভিয়ে কিভাবে উদ্ধার করা যাবে....?
-স্যার হেলিকপ্টার ব্যাবহার করা যায়..!
-আচ্ছা..।
রাজু হেলিকপ্টার এর ব্যাপারে ক্যাপ্টেন কাব্যের সাথে কথা বলার জন্য যখনি ডান দিকে তাকায় তখন তিনি দেখেন কাব্য সেখানে নেই। পাশে থাকা সৈনিককে বলেন
-ক্যাপ্টেন কাব্য কোথায়..?
লীলাপ্লাজার সামনের বিল্ডিং টিকে হাত দিয়ে ইশারা করে ওই সোনিক বলে
-ক্যাপ্টেন এই দিকে গিয়েছিলেন..!
বেশ বিরক্ত হলেন কর্নেল রাজু, কারন তারা দুজনই একটা অপারেশনে এসেছে তাই যে কোন কাজের আগে পরামর্শ করে নেওয়া খুব জরুরী। নিজের বিরক্তি নিয়ে তিনি ওই সৈনিককে কি যেন বলতে যাবেন তখনই তিনি ফায়ারিং এর শব্দে থমকে গেলেন। শব্দটা উপরের দিক থেকে এসেছে।
উপরের দিক তাকিয়ে দেখেন ক্যাপ্টেন কাব্য সামনের বিল্ডিং এর ছাদ থেকে দড়িতে ঝুলে লীলাপ্লাজার ৭ম তলায় যাচ্ছেন। আর এই দৃশ্য দেখে রাজু মনে মনেই বলে
-জানের পরোয়াও নেই..!
লীলাপ্লাজায় গিয়ে কাব্য বলে
- সবাই বসে পড়ুন..!
তার কথা মত সবাই বসে পড়লে সে শুরু করে ফায়ারিং। গার্মেন্টস এর চারদিকের থাই গ্লাস মুহুর্তেই গুড়িয়ে দেন তিনি। এবার তিনি ওয়াকিটকি দিয়ে কর্নেল রাজুর সাথে কথা বলেন
-স্যার..?
-ক্যাপ্টেন কাব্য..?
-ইয়েস স্যার
-কি করতে হবে..?
-আমাদের সকল সৈনিককে নিয়ে লীলাপ্লাজার পেছনের দিকে চলে আসুন...!
লীলাপ্লাজার পেছনে ছিল একটা পুকুর আর পুকুরের ওপাশে ৩ তিলা একটা বিল্ডিং। কাব্য এবার নিজের কাধ থেকে দড়ি বের করে ছেড়ে দেয় নিচে সেখান থেকে একজন সৈনিক সেই দড়ি নিয়ে সেই ৩ তলা বিল্ডিং এর ছাদে বেধে দেয়। কাব্য এবার একসাথে ৪ জন লোককে হুক দিয়ে বেধে ঝুলিয়ে দেয় দড়িতে। প্লান হল যদি দড়ি ছিড়েও যায় তবুও মানুষ যেন পুকুরের মধ্যে পড়ে।
৪
রাত ২ টা বেজে ৩৪ মিনিট। প্রতিদিনের মত ক্যাপ্টেন কাব্য তার টিম নিয়ে ঝিকরগাছা সীমান্তে টহলে বেরিয়েছেন। বোরো মৌসুমের ধান কেটে নেওয়ায় মাঠ এখন ফাকা আর সেই ফাকা মাঠের মধ্য দিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে যাচ্ছেন ক্যাপ্টেন, আর তাকে অনুসরণ করছে তার দল।
কিন্তু হুট করেই দলের সামনে থাকা ক্যাপ্টেন কাব্য দাঁড়িয়ে গেলেন। হাত দিয়ে সবাই কে বসার ইশারা করে নিজেও বসলেন। বসে থেকেই তিনি তার দলকে নিঃশব্দে কিছু শোনার ইংগিত করলেন।
প্রায় দুই মিনিটের মত সেখানে বসে থেকে তিনি তার দলের ৬ জনকে নির্দেশ দিলেন দক্ষিণ দিক দিয়ে ঘুরে আসতে আর নিজে উত্তর দিক দিয়ে ঘুরে আসলেন।
৫ মিনিট পর সীমান্তের কাটাতার থেকে প্রায় ৫০-৬০ মিটার এদিকে একসাথে প্রায় ১২-১৩ টা টর্চলাইট জ্বলে উঠল। টর্চের আলোয় দেখা গেল ৫টা ছেলে তিনটা বস্তা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরিস্থিতি নিজেদের অনুকুলে দেখে কাব্য বলল
-স্যারেন্ডার করো, না হলে এখনি শ্যূট করব।
মুখ দেখাদেখি করে ওই ছেলেদের মধ্যে একজন ভারতের দিকে ইশারা করে বলে
-বিএসএফ এর সোলজার গুলো আমাদের দেখেও কিছু বলে না কিন্তু তোদের কতবড় কলিজা আমাদের দিকে বন্দুক তাক করিস...?
-ওরা এগুলো করে বলেই ওরা বিএসএফ আর আমরা বিজিবি..!
ওরা চুপচাপ রইল কিছু সময়, তারপর আবার বলে
-সবাই ৫ লাখ করে পাবি, চেপে যা...!
-আর একবার কথা বললে এখনি মারা পড়বি..!
এবার সেই ছেলেটি কোমর থেকে একটা পিস্তল বের করে লোড করতে করতে বলে
-কুত্তার বাচ্চা জানিস আমি কে...?
কোমর থেকে পিস্তল বের করার দৃশ্য কিন্তু ক্যাপ্টেন কাব্যের চোখ এড়ায় নি। লোড করে ফায়ার করার আগেই গর্জে উঠল ক্যাপ্টেন কাব্যের হাতে থাকা রাইফেল। সাথে সাথে ছেলেটি চিৎকার করে মাটিতে পড়ে গেল। গুলিটি তার ডান হাতে লেগেছে..!
--------------------------------------------
রাত ৩:২৬,
মেজর হাসান হায়দার এর ব্যক্তিগত মোবাইলে রিং হচ্ছে। দুইবার রিং হয়ে কেটে যাওয়ার পর তিনবারে ফোন রিসিভ করলেন তিনি। রিসিভ করে তিনি বলেন
-হ্যালো.?
-মেজর হাসান হায়দার বলছেন..?
-জ্বী, আপনি..?
-আমি যশোরের এম. পি জাহিদ বাহাদুর বলছি..!
-বলুন..!
-ক্যাপ্টেন কাব্য, আমার ৫ টা ছেলেকে এরেস্ট করেছে
-তো..?
-ওদের ছেড়ে দিতে বলেন..!
কথা শুনে কিছুসময় চুপ করে রইলেন হায়দার সাহেব। নীরবতা ভেংগে তিনি বলেন
-আপনি ফোন রাখতে পারেন..!
-আপনি কার সাথে কথা বলছেন জানেন..?
-ভয় পুলিশ বাহীনিকে দেখাবেন আমাদের না...।
--------------------------------------------
আর ঘুম হল না মেজর হাসান হায়দার এর। অনেক গুলো প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর না পেলে তিনি ঘুমাতে পারবেন না। বেলকনিতে গিয়ে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে তিনি মোবাইল বের করে ফোন করলেন মেইনটেনেন্স রুমে। ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হওয়ার সাথে সাথে বললেল
-মেজর হাসান হায়দার বলছি
-ইয়েস স্যার
-ক্যাপ্টেন কাব্য এখন কোথায়..?
-চেক করে বলছি স্যার..
কম্পিউটার এ চেক করে ওদিক থেকে উত্তর এলো
-ক্যাপ্টেন কাব্য এখন ঝিকরগাছা সীমান্তে টহলে আছেন
-কোন কিছু ইনফর্ম করেছে না কি সে..?
-ইয়েস স্যার..!
-কি জানিয়েছে..?
-ক্যাপ্টেন কাব্য প্রায় ২০ কোটি টাকার হেরোইন এবং ১০ টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছেন
-হোয়াট..?
-আই রিপিট
ফোন কেটে দিলেন মেজর হায়দার। তার কাছে এবার সব পরিষ্কার হয়ে গেল। কেন জাহিদ তাকে ফোন দিল..?
৫
কাব্য মেজরের ডাক পেয়ে তড়িঘড়ি করে রওনা দিল মেজরের অফিসের দিকে। কাব্যের কাছে এটা নতুন কোন ঘটনা না। মেজর হাসান হায়দার প্রায়ই তাকে এভাবে ডাকেন। কাব্য হায়দার সাহেবের অফিসে যাওয়ার সময় দেখা হল রাজুর সাথে। কাব্য কে দেখেই রাজু বলে
-কাব্য..?
-ইয়েস স্যার..?
-ভাইরাল হয়ে গেছো, জানো....?
-না তো..!
-তোমার দড়িতে ঝুলে লীলাপ্লাজায় যাওয়ার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে
-বাংলাদেশে প্রতিদিন অনেক ভিডিও ভাইরাল হয় স্যার..!
-ঠিক
-আমাকে মেজর একটু ডেকেছে স্যার...!
-ওকে যাও...!
কাব্য আসতে দেরি করছে দেখে মেজরের আজ রাগ হচ্ছে। কাব্যের দেরি দেখে তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালেন কাব্যের কাছে যাবেন ভেবে। কিন্তু তখনি কাব্য রুমে ঢুকে পা ঠুকে স্যালুট দিয়ে বলে
-স্যার ডেকেছেন আমায়..?
-কাব্য..?
-ইয়েস স্যার..।
-একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবা আন অফিসিয়ালি..?
-চেষ্টা করব স্যার...!
পেপার ওয়েট খানা টেবিলের উপর ঘোরাতে ঘোরাতে মেজর বলেন
-যদি কখনো তোমার নীতি আদর্শ ক্ষমতার মুখোমুখি হয়, কি করবে তুমি...?
-স্যার এই ইউনিফর্ম যেদিন গায়ে দিয়েছি সেদিনই নিজের কাফন পরে নিয়েছি, প্রতিটি সেকেন্ড অপেক্ষা করি কবে শহীদ হতে পারব, কবে আমার লাশ বাংলাদেশ আর্মি পুর্ন মর্যাদায় তোপধ্বনি দিয়ে কবরস্ত করবে...!
এতটুকু বলে আর কথা বলতে পারল না কাব্য। এত সময় মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার কথা শুনছিল মেজর হাসান হায়দার। কাব্য আর কথা বলছে না এই বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল হায়দার সাহেবের। নিজে স্বাভাবিক হয়ে দেখতে পেলেন তিনি কাব্য কান্না করছে। তিনি বুঝতে পারলেন দেশের প্রতি কাব্য কতটা সেন্সিয়াস। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হাসান সাহেব বলেন
-ক্যাপ্টেন কাব্য..?
-ইয়েস স্যার..?
-মিডিয়া রুমে কনফারেন্স এর ব্যবস্থা করো, প্রেস ব্রিফিং করতে হবে...!
-ওকে স্যার..!
পা ঠুকে স্যালুট দিয়ে বেরিয়ে গেল কাব্য। আর তার পথের দিকে এক নজরে তাকিয়ে রইলেন মেজর হাসান হায়দার..!
৬
যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে খবর পেয়ে সাংবাদিকরা আসা শুরু করেছে ক্যান্টনমেন্ট এ। মেজর হাসান হায়দার নিজের অফিসের সামনে পেছনে হাত বেধে দাঁড়িয়ে সাংবাদিক দের আগমন দেখছেন। অন্যদিকে ক্যাপ্টেন কাব্য উদ্ধারকৃত মাদক, অস্ত্র আর আসামীদের নিয়ে অপেক্ষা করছেন কনফারেন্স রুমে।
একটি টিভি চ্যানেলের গাড়ি ক্যান্টনমেন্টে ঢুকতে দেখে বেশ খুশিই হলেন মেজর হায়দার। কিন্তু তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন পরের দৃশ্য দেখে। মিডিয়ার গাড়ি যখন ক্যান্টনমেন্টে ঢুকবে ঠিক তার আগ মুহুর্তে ক্যান্টনমেন্টের গেট দিয়ে উদভ্রান্তের মত দৌড়ে প্রবেশ করলেন তার স্ত্রী, নাজমিন আক্তার।
ক্যান্টনমেন্ট এর রাস্তার ধুলো উড়িয়ে আসা মিডিয়ার গাড়ি দুইটি ইমার্জেঞ্জি ব্রেক করে দাঁড়িয়ে গেল আর অন্য দিকে দাঁড়িয়ে থাকা হাসান হায়দার ছুট লাগালেন তার স্ত্রীর দিকে। যশোর ক্যান্টনমেন্টের মেজর কে দৌড়াতে দেখে পাশে থাকা সৈন্যরাও তার পিছুপিছু দৌড়াতে থাকে। নাজমিন দৌড়াতে গিয়ে শাড়িতে পা আটকে আছড়ে পড়েন পিচঢালা রাস্তার উপর। আর ততক্ষণে পৌছে গেছে হায়দার।
রাস্তায় পড়ে থাকা তার স্ত্রী নাজমিন কে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন মেজর হাসান হায়দার...।
---------------------------------------
-উদ্ধার হওয়া মাদকের উৎস্য সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া গেছে ক্যাপ্টেন...?
এক নারী সাংবাদিকের প্রশ্নে সামনের দিকে তাকালেন ক্যাপ্টেন কাব্য। নিজের স্বাভাবিক গাম্ভীর্য মুখে রেখে উত্তর দিলেন
-অনুমান করা ছাড়া কোন কথাই বলা যাবে না, তবে প্যাকেটের গায়ে হিন্দি লেখা দেখে মনে হচ্ছে মাদকের ঊৎস্য ভারত..!
-এই বিশাল পরিমাণ মাদক সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদশে ঢোকার পেছনে কি প্রশাসন কোন ভাবে যুক্ত....?
-এখনো তেমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি, তদন্তছাড়া কোন মন্তব্য করা যাবে না..!
-এই মাদক এবং অস্ত্রের আমদানি কারা করেছে বলে মনে করেন..?
নিজের সান গ্লাস খুলে টেবিলের উপর রেখে কাব্য স্মীত হাসি দিয়ে বলে
-দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে আই এসের মদদে এই অস্ত্র দেশে ঢুকেছে, এই প্রতিবেদন তৈরীর আগে শুনুন, এই অস্ত্র যারাই আমদানি করেছে কেউ বিন্দুমাত্র ছাড় পাবে না...!
---------------------------------------
-বহ্নি এখনো বাসায় ফেরে নি গো...!
স্বামীর বাহুতে আবদ্ধ হয়ে আর্তনাদ করে কথাটা বলল নাজমিন। স্ত্রীর কথা শুনে বেশ অবাক হলেন মেজর। তার মেয়েটা হয়েছে তার মত। কারো কোন কথা সে শোনে না। নিয়ম তার চোখের বালি। সেই মেয়ে টিউশন থেকে ফিরতে ঘন্টা খানেক দেরি করায় এতটা উদগ্রীব হওয়ার কোন মানেই নেই। এই ভেবে তিনি স্ত্রীকে বলেন
-গেছে হয়ত কোথাও, তোমার মেয়েকে চেন না তুমি...?
নিজের স্বামী, মেজর হাসান হায়দার এর কলার দুহাতে আঁকড়ে নাজমিন ধরা গলায় বলে
-তোমার মেয়ে কোথাও যায় নি, ওকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে...!
সুনামির ধাক্কা খেল হায়দার, যখন তার স্ত্রী নিজের মোবাইল বের করে একটা কল রেকর্ড শোনানো শুরু করল....!
৭
পরের দিন,
সকাল ৯ টা, নির্ঘুম রাত পার করে নিজের দায়িত্ব পালন করতে ক্যান্টনমেন্টে নিজের অফিসে ওয়াকিটকি নিয়ে পায়চারি করছেন মেজর। কাল দুপুর থেকে পুলিশ এবং তার সহকর্মীরা তার মেয়েকে খোজার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখন অব্দি কোন খবর তিনি পান নি। যতবারই তার ওয়াকিটকি কিংবা মোবাইল বেজে উঠছে ততবারই তিনি কেঁপে উঠছেন এই ভেবে
-এই বুঝি বহ্নির খবর দেবে।
অন্যদিকে সারারাত কেঁদে নিজের চেহারা ফুলিয়ে ফেলেছে নাজমিন। বড় মেয়ে তার, নাড়ি ছেড়া ধন। নিজের স্বামীর চাকরি আর কর্তব্যপরায়ণতা নিয়ে এত দিন তিনি গর্ব করে এসেছেন আর আজ তার ঘৃণা হচ্ছে তার স্বামীর পেশার প্রতি। বারবার তার মনে প্রশ্ন জাগছে
-কি দরকার সেই চাকরির যেখানে নিজের পরিবার অনিরাপদ...?
------------------------------------
সিনিয়র অফিসার রাজু মেজরের রুমে প্রবেশ করে কেতাবি ডং এ পা ঠুকে স্যালুট দিয়ে বলে
-স্যার...?
ওয়াকিটকি হাতে নিজের টেবিলের উপর হামাগুড়ি দিয়ে থাকা মেজর হায়দার মাথা উচু করে বলে
-রাজু...?
-ইয়েস স্যার..!
-কাব্য কোথায়..?
-স্যার বাইরে আছে...!
রাজুর উত্তর শুনে আবার চুপ করে রইল হায়দার। মাথা নিচু করে সারা রাতের ক্লান্তি কমানো চেষ্টা করছেন। কিন্তু হুট করে তিনি বুঝতে পারেন, রাজু তার রুম থেকে যায় নি। এবার তিনি ভাবলেন নিশ্চয় রাজু কিছু বলবে, নাহলে সে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকত না। শুধু রাজুই না কেউই কোন প্রয়োজন ছাড়া তার রুমে আসে না। আবার মাথা উচু করে বলে
-কিছু বলবে...?
রাজু কেমন যেন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল মেজরের প্রশ্নে। নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলে
-স্যার, একটু বাইরে আসবেন....?
-কেন...?
রাজু আর কোন উত্তর দেয় না, ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তার দাঁড়িয়ে থাকা দেখে মেজর আর কোন কথা না বলে বেরিয়ে পড়ে।
-----------------------------------------
পিচঢালা ক্যান্তনমেন্টের রাস্তার উপর একটা কফিন রাখা, সে কফিন ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ২০ জন সেনা। হুট করেই কফিন দেখে হায়দার ভাবলেন কোন সৈনিক হয়ত মারা গেছে। কিন্তু পরক্ষণেই সে ভাবে, কোন সৈনিকের কিছু হলে সে তো খবর পেত।
অনাকাঙ্ক্ষিত কোন ঘটনার জন্য মানষিক প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে হায়দার। রাজু ইশারায় দুইজন সৈনিক কফিনের ঢাকনা সরিয়ে দিল।
সাদা কাপড়ে মোড়ানো একটা লাশ, তার মুখ ঢাকা রয়েছে। মেজরের খুব ইচ্ছা করছে লাশের মুখটা দেখতে। কিন্তু সে কাউকে বলতে পারছেনা। ঠিক তখনি মেজর হাসান হায়দারকে ৪৪০ ভোল্টের শক দিয়ে বাতাস এসে কাফনের কাপড় সরিয়ে দেয়। আলগা হয়ে যায় মুখ।
লাশের মুখ দেখেই দুইপা পিছিয়ে যান মেজর। মিনিট খানিক সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে কফিনের দিকে এগিয়ে যায় হায়দার। কফিনে থাকা নিজের মেয়ের মুখটা ধরে যখন তিনি কান্না করতে যাবেন তখনি ক্যান্টনমেন্ট স্কুক এন্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রাত্যহিক সমাবেশের নিয়ম মাফিক গেয়ে ওঠে
""""আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি""
সাথে সাথে মেয়ের মুখ ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাড়ান মেজর হাসান হায়দার। দুই পা ভি(V) সেপে রেখে পুর্ণ সম্মান প্রদান করেন জাতীয় সঙ্গীতের। আর তখন ঠিক তার মাথার উপর পতপত করে উড়তে থাকে লাল সবুজের পতাকা....!
৮
মেজরের দেশপ্রেম দেখে এত সময় অবাক হয়ে থাকা রাজুর হুট করে খেয়াল হল, তার পেছনে ক্যাপ্টেন কাব্য নেই। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সৈনিককে প্রশ্ন করে
-ক্যাপ্টেন কাব্য......
ঠিক সেই মুহুর্তে বিকট শব্দে ভেঙ্গে যায় ক্যান্টনমেন্টের মেইন গেট আর সবাই দেখে একটা ট্যাংক বেরিয়ে গেল চোখের সামনে দিয়ে। বেরিয়ে যাওয়া ট্যাংক দেখে মেজর পেছন ফিরে রাজু কে জিজ্ঞাসা করে
-ক্যাপ্টেন কাব্য কোথায়...?
রাজু উত্তর দিতে যাবে তখন একজন সৈনিক হাফাতে হাফাতে এসে বলে
-মেজর, ক্যাপ্টেন কাব্য আর্মস আর ট্যাংক নিয়ে বেরিয়ে গেলেন কেবল...!
সৈনিকের কথা শুনে মেজর জবাবে বলে
-হোয়াট...!
----------------------------------------
-শালা মেজরের বিরাট শিক্ষা হল নাকি...?
যশোরের সাংসদ জাহিদ এর প্রশ্নে তার চেলা উত্তর দেয়
-হ্যা ভাই, হারামজাদা বুঝে নি জলে থেকে কুমিরের সাথে লড়াই করা যায় না..!
চেলার কথা শুনে একটা হাসি দিয়ে জাহিদ আবার বলে
-শালা বুঝতে পারে নি পলিটিশিয়ানের ক্ষমতা কত, ও বুঝে নি, পলিটিশিয়ান মানে ম্যাজিশিয়ান...!
জাহিদের কথায় সবাই হো হো করে হাসা শুরু করে। আর তখনি বিকট একটা শব্দে কেঁপে উঠে জাহিদের বাড়ি। বাইরে থেকে এক চেপা দৌড়ে এসে বলে
-ভাই, ভাই, ক্যাপ্টেন কাব্য ট্যাংক নিয়ে এসে আমাদের মেইন গেট উড়িয়ে দিয়েছে..!
-কি...?
প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা না করে জাহিদ বলে
-কুত্তার বাচ্চা যেন জীবিত বের হতে না পারে, শুরু করে দে...!
-------------------------------------------------
রাজু জীপ নিয়ে ছুটছে আর ওয়াকিটকি দিয়ে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে বলছে
-কর্নেল রাজু বলছি, ইমিডিয়েট পুলিশ ফোর্স নিয়ে জাহিদ বাহাদুরের বাড়ি পৌছান, ক্যাপ্টেন কাব্য অন ফায়ার, আই রিপিট, ক্যাপ্টেন কাব্য অন ফায়ার...!
----------------------------------------
কাব্য জাহিদের বাড়ির ছাদে থাকা গর্জনরত সিংহের মূর্তি লক্ষ্য করে ট্যাংক ফায়ার করে গুড়িয়ে দেয় সে মুর্তি। মূর্তি গুড়িয়ে দিয়ে একটা মর্টার আর একটা একে৪৭ নিয়ে ট্যাংক থেকে নামে কাব্য। ট্যাংকের গেট খুলেই ফায়ার শুরু করে কাব্য।
তার দিকে দৌড়ে আসতে থাকা জাহিদের সব চেলা বুলেটের আঘাতে দুরেই পড়তে শুরু করে।
-----------------------------------
চারদিকে ধ্বংসের চিহ্ন, যেখানে সেখানে পড়ে আছে মৃত দেহ। মনে হচ্ছে সেনাবাহিনীর আক্রমণে কোন জঙ্গি ঘাটির দৃশ্য এটি কিন্তু রাজু জানে এ দৃশ্য যশোরের সাংসদ জাহিদের বাড়ির। আর এসব কাজ করেছে একজন। ক্যাপ্টেন কাব্য।
খুজতে খুজতে দুই তলায় গিয়ে রাজু পায় কাব্যকে। সারা শরীর বুলেটে ঝাঁজরা হয়ে গেছে কিন্তু ডান হাত দিয়ে ঠিকই ধরে রেখেছে জাহিদের টেবিলে থাকা জাতীয় পতাকা। রাজু অনুমান করছে হয়ত আক্রমণের সময় এটা পড়ে যাচ্ছিল আর সেটা মাটিতে পড়তে দেয় নি কাব্য।
কাব্যকে বাহুতে নিজে রাজু বলে
-ক্যাপ্টেন, ক্যাপ্টেন..?
খুব কষ্টে চোখ মেলে কাব্য বলে
-স্যার..?
-ইয়েস কাব্য..!
-সীমান্তে জীবন বাজি রেখে আমরা দেশকে রক্ষা করি কিন্তু দেশের কিছু কীট আমাদেরিই অনিরাপদ করে ফেলে তাই না...?
কান্নারত অবস্থায় রাজু উত্তর দেয়
-ইয়েস ক্যাপ্টেন..!
-তাই আজ একটা কীটকে ধ্বংস করে দিলাম, আমি কি অন্যায় করেছি স্যার..?
-নো ক্যাপ্টেন
একটু দম নিয়ে কাব্য আবার বলে
-স্যার..?
-ইয়েস ক্যাপ্টেন...?
-আপনি আমার ইচ্ছা জানতে চাইতেন না..?
-হ্যা..!
-শুনবেন আজ..?
-ইয়েস ক্যাপ্টেন..!
-আই ওয়ান্ট টু ডাই এজ এ সোলজার স্যার..!
-ইয়েস ক্যাপ্টেন...!
-স্যার..?
-ইয়েস কাব্য..?
-আমার সামনে পতাকাটা ধরে একটু স্যালুট করিয়ে দেবেন স্যার..?
রাজু পতাকা সামনে ধরে কাব্যের ডান হাত কপাল অব্দি তুলে ধরে, কাব্য তখন জীবনের শেষ শব্দটা বলে
-জয় বাংলা...!
থেমে যায় কাব্যের কথা, চারদিকে শুনশান নীরবতা। আর সেই নীরবতাই যেন স্বর্গীয় শান্তি এনে দিল কাব্য কে। পেছন থেকে মেজর হাসান হায়দার তখন বলে
-ইয়েস কাব্য, ইউ আর এ সোলজার...!
লেখা: Atikul Islam
Comments (0)