Search

অনুগল্পঃ প্রতিশোধ

  • Share this:

এই বাড়িতে প্রতি বছর একজন করে সদস্য আত্নহত্যা করে । সব থেকে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, যিনি আত্নহত্যা করেন তার ঠিক তিনমাস আগে থেকে তার দুই পায়ে প্রচন্ড রকমের ব্যাথা হতে থাকে। ব্যাথার চোটে সে হাটাহাটি করতে পারে না। আর অবাক করার মত ব্যাপার হচ্ছে শত-শত ডাক্তার, কবিরাজ দেখিয়েও এমন রোগ থেকে তারা কেউই পরিত্রান পান নি। শত চেষ্টা করেও এই বাড়ির এমন রহস্য কেউ উদঘাটন করতে পারে না। গতকাল রাতে যিনি সুইসাইড করেছে তার নাম ইউনুস। আমার চাচাতো ভাই ছিলেন ইউনুস। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল ৩০ এর কাছাকাছি। ইউনুস ভাইয়ের মৃত্যুতে তার স্ত্রী অনেক ভেংগে পড়েছিল। ভেংগে পড়াটাই স্বাভাবিক। কারন তিনি যখন পাশের বাড়ির আসমা চাচীর বাড়িতে ঘন্টাখানেকের জন্য টিভি দেখতে গিয়েছিলেন সেই সময়ের মধ্যেই ইউনুস ভাই এমন অঘটন ঘটিয়ে ফেলে। এত অল্প সময়ের মাঝে যে একটা মানুষ গলায় ফাস দিয়ে মরতে পারে ইউনুস ভাইয়ের স্ত্রী সেটা যেন কিছুতেই মেনে নিচ্ছেন না। সত্যি অবাক করার মত ব্যাপার একটা না,দুইটা না এপর্যন্ত এই বাড়িতে ছয়-ছয়টা মানুষের প্রান গেল তাও আবার ফাস আটকিয়ে। আর বাকি ৫ জন মৃত্যু ব্যাক্তির সাথে ইউনুস ভাইয়ের মৃত্যুর সম্পুর্ন মিলও রয়েছে। শুধু ইউনুসের মৃত্যুর ক্ষেত্রে না,অতীতে যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের সবার সাথে সবারই মিল ছিল । আর সব থেকে লক্ষনীয় ব্যাপার হলো সব মৃত্যু ব্যাক্তির দুটো চোখের মনির ভেতরেই খেজুরের কাটা ফুঁড়ানো থাকতো । ইউনুস ভাইয়ের চোখেও খেজুরের কাটা ফুড়ানো অবস্থায় ছিল। কিন্তু এর পিছনে কি কারন বা রহস্য ছিল কেউই তা উদঘাটন করতে পারে না। এই গ্রামের লোকেরা শুধু এটাই দেখে আসছে, এই বাড়িতে প্রতি বছর কেউ না কেউ গলায় ফাস দিয়ে মারা যায়। আর যিনি মারা যান তিনি আগে থেকেই বুঝতে পারেন তিনি মারা যাবেন। কেননা তার মারা যাওয়ার ঠিক তিনমাস আগে থেকে তার পায়ের মধ্যে প্রচন্ড রকমের ব্যাথা শুরু হয় হয়। সেই সাথে মারা যাওয়ার পর লাশের চোখের মধ্যে খেজুরের কাটা ফুড়ানো থাকে। এর বেশি কিছু এখানে কেউ জানে না। তবে আমাদের গ্রামের সবার ধারনা ইউনুসের মতো বাকি সবার মৃত্যুর পিছনে অশুভ কোন শক্তির হাত রয়েছে। মাঝে মাঝে নাকি ইউনুস ভাইয়ের বাড়ির আশেপাশে একজন কালো বোরখা পড়া মহিলাকে ঘুরতে দেখা যায়। কাছেই গেলেই নাকি অদৃশ্য হয়ে যায়। অতীন্দ্রিয় সেই রহস্য।

.

ময়না তদন্ত্র করে ইউনুস ভাইয়ের লাশটা আনা হয়েছে। কিন্তু ময়না তদন্তে এমন কোন আলামত পাওয়া যায় নি যেটা ইউনুস ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী। আমি অবশ্য ময়না তদন্তের অনেক আগে থেকেই ধারনা করে নিয়েছিলাম,তার মৃত্যুর জন্য দায়ী এমন কোন আলামতের চিহ্ন পাওয়া যাবে না। কেননা এই বাড়িতে অতীতে যারা ফাস দিয়ে মরেছিল তাদের সবার ক্ষেত্রেও পাওয়া যায় নি। যাইহোক লাশ সকল বাধা বিপত্তি উতরনোর পর অবশেষে রাত ১০ টার দিকে হারিকেন আলোতে ইউনুস ভাইয়ের কবর দেওয়া সম্পুর্ন হলো। কবর দেওয়া সম্পুর্ন হলেও তখনো আমার মাথার ভিতরে একটা অজানা রহস্য উদঘাটনের জন্য বেশ অস্থির হয়ে পড়ছিলাম। বার, বার শুধু মনের ভেতর একটা প্রশ্নই খেলা করেছিল,"কি আছে এই বাড়িতে,যার জন্য প্রতিবছরে একজন করে গলায় ফাস দিয়ে মারা যায় ? " আর মারা যাওয়ার আগেই বা কেন দুই পা এত ব্যাথা করে,কেনই বা মৃত ব্যাক্তির চোখের মনিতে খেজুর কাটা ফুড়ানো থাকে ? আমি প্রশ্নের উত্তর খুজতে থাকি। অনেক খুজি। খুজতে খুজতে ক্লান্ত হয়ে একটা সময়ে সেই রহস্য উদঘাটনের আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই রহমান দাদার কাছ থেকে জানতে পারলাম, ইউনুস ভাইয়ের বাড়িতে নাকি একজন কাজের লোক থাকতেন। তার নাম মোবারক মিয়া। এই মোবারক নামের লোকটি নাকি ইউনুসের বড় ভাইয়ের বউকে নিয়ে পালিয়ে যায়। আর তিনি চলে যাওয়ার পরের বছর থেকেই নাকি এই বাড়িতে এমন হচ্ছে। রহমান দাদার কথা শুনে বুকে কিছুটা আশার সঞ্চয় জাগলো। আমার কেন জানি মনে হতে লাগলো, হয়ত এই মোবারক নামের মানুষটাই বলে দিতে পারবে এই বাড়ির এমন অতীন্দ্রিয় রহস্যের পিছনের কাহিনীটা কি ছিল ?

.

মোবারক মিয়া মুখ খুললেন। প্রথম প্রথম না বলতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত বলতে লাগলেন,তিনি যেসময় ইউনুস ভাইদের বাসায় কাজের লোক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন সেসময় ইউনুসেরা ছিলেন ছয় ভাই দুইবোন। এর মধ্যে ইউনুসের বড় ভাইয়ের নাম

ছিল ইকরাম। ইকরাম ভাইজান ছিলেন খুবই নোংরা মনের মানুষ। তিনি অকারনেই তার বউয়ের গায়ে হাত তুলতেন। বউয়ের সামনেই অন্য মেয়েদের সাথে মোবাইলে কথা বলতেন। আর এই সব নিয়ে যখনই তার বউ কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই ভাবীজানের ওপর মাইর ধোড় করতেন । আর ভাবীজান সেই মাইর খেয়ে বাচাও,বাচাও বলে চিৎকার দিতেন। কিন্তু অবাক করার মত ব্যাপার এসময় কেউ তাকে বাঁচানোর জন্য আসতেন না। এমন-ই এক দুপুর বেলার কাহিনী,সেদিন ইকরাম ভাইজান তার বউকে লাঠি দিয়ে পিঠাচ্ছিলেন। পিঠানোর এক পর্যায়ে তার স্ত্রী ল্যাংড়া হয়ে গেলন। সে সময় ও ভাবীজানকে বাচাতে কেউ আসে নি। ইকরাম ভাইজানের অন্য ভাই গুলো শুধু দাড়িয়ে,দাড়িয়ে এইসব দেখছিল। আমি সেবার বাচাতে গেলে মাথার মধ্যে প্রচন্ড রকমের আঘাত পাই। এর পর কি হলো, "জানেন ?" আমি বললাম, "কি হলো ?" তিনি বললেন,এরপর তিনি ল্যাংড়া পা নিয়ে বিছানায় সারারাত ব্যাথায় ছটপট করত। আর ব্যাথা উঠলেই চিল্লাতো। আর ইকরাম ভাইজান এইসব পাত্তা না দিয়া আপন মনে কার সাথে যেন মোবাইলে কথা বলতেন। তিনি অন্য মহিলার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছিল। এসব দেখে ইকরাম ভাইজানের বউ চোখ গরম করে ইকরাম সাহেবর দিকে তাকিয়ে থাকতেন। ইকরাম ভাইজান ছিলেন নির্দয় মানুষ । তাই শেষ পর্যন্ত তিনি ভাবীজানকে শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে ফেললেন। কিভাবে মেরে ফেলেছিল জানেন ? আমি যেই বলতে যাব কিভাবে তার আগে তিনি নিজে থেকেই বলতে লাগলেন, প্রথমে ভাবীজানের মুখে লাইনের দড়ি পেঁচিয়ে গিট দেয়। এরপর ভাবীর হাত পা বেধে ফেলে । আর যখন হাত পা বেধেছিল ভাবী তখন ইকরাম ভাইজানের প্রতি চোখ বড় বড় করে দেখছিলেন। আর এটা মনে হয় তার সহ্য হচ্ছিলো না । তাই তিনি বাসার পেছন থেকে দুইটা খেজুরের কাটা এনে ভাবীজানের চোখের মণিতে হেনে দিলেন। একটা পর্যায়ে গলায় গামছা পেছিয়ে ভাবীকে মেরে ফেললেন। আর হত্যা করার পর ইকরাম ভাইজান ভাবীরে চাদর পেচিয়ে সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে যেই না বাইরে বের হচ্ছিলেন ঠিক তখন-ই আমি কি যেন মনে করে ওনার ঘরে ঢুকে যাই। আমি হুট করে ইকরাম ভাইজানের ঘরে ঢোকার ফলে তার সব অপকর্ম দেখে ফেলি। আর তাই ইকরাম সাহেব আমাকেও হত্যা করতে চেয়েছিলেন। আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম ওনার কাজ কর্মে। তাই আমি ইকরাম ভাইজানের পা ধরে প্রান ভিক্ষা চাই। আর সে রাতেই সেই বাড়ি থেকে চলে এই পলাশপীরে চলে আসি । আমার চলে আসাতে তিনি সবাইকে বলে দিয়েছিলেন যে,মোবারক মিয়া তার বউরে পালিয়ে নিয়ে গেছে। তাদের মধ্যে প্রেম ভালবাসা ছিল। আর সেদিনের কিছুদিন পেরিয়ে যেতেই ওই বাড়িতে এরকম মৃত্যু হতে দেখা যায়। মোবারক মিয়া বিশ্বাস করেন যে,এটা ইকরাম সাহেবের পাপ কর্মের ফল। কারন তিনি তার স্ত্রীকে অনেক নির্যাতন করে মেরেছন। এতটাই নির্যাতনের শিকার তিনি হয়েছেন, যে তার স্ত্রীর মৃত্যুর গোসল পর্যন্ত হয় নি। জানাজা তো দুরের কথা, তাকে তো রাতের আধারেই একটা গর্ত করে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়। ইকরাম সাহেব হয়ত ভেবেছিলেন গল্পটার পরিসমাপ্তি হয়ত এখানেই শেষ হবে,কিন্তু নিয়তির সেই অদ্ভুত খেলা কি কখনো শেষ হয় ? ইকরাম সাহেব শাস্তি পেয়েছে সেই সাথে শাস্তি পেয়েছে ইকরাম সাহেবের ভাইয়েরা। যারা চোখ বুঝে ইকরাম সাহেবের স্ত্রীর নির্যাতন দেখেছিল । প্রকৃতির নিয়ম সত্যি বরই অদ্ভুত নিয়ম। কথায় আছে,পাপ বাপকেও ছাড়ে না। পাপের প্রায়শ্চিত্ত আপনাকে ভোগ করতেই হবে, তা আপনি যেই হোন না কেন, যত ক্ষমতাশালী হোন না কেন। প্রকৃতির বিরুদ্ধে গেলে, প্রকৃতি কখন প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে ওঠে তা বোঝার সময় দেয় না, ঠিকই প্রতিশোধ নিয়ে ফেলে।

.

রাসেল আহমেদ

Tags:

About author
আমি গল্প এবং বই প্রেমিক একজন মানুষ। গল্প এবং বই পড়তে খুবই ভালোবাসি। যেখানেই যে গল্প অথবা কাহিনী খুজে পাই সেগুলো সংগ্রহ করি এবং আপনাদের সাথে শেয়ার করার চেষ্টা করি। আমি নিজেও কয়েকটি গল্প লিখেছি তবে সেগুলোর সংখ্যাটা খুবই সামান্য।