'ডাক্তাররা বললেন, 'মিঃ সাইদুল, আপনার স্ত্রী আর আপনার সন্তানের মধ্যে যেকোনো একজন কে বাঁচাতে পারবো। আপনি কাকে বাঁচাতে চান?'
যে আমি অফিসে নীল শার্ট পরে যাব নাকি সাদা শার্ট পরে যাব সেটা ঠিক করতেই হিমশিম খেয়ে যেতাম সেই আমাকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে আমি আমার স্ত্রী কে বেছে নিব নাকি আমার সন্তানকে বেছে নিব। চিন্তা কর বিষয় টা! কতটা ভয়ানক পরিস্থিতি তখন।
আমি থতমত খেয়ে বললাম, 'আমি একটু পরে বলছি। আমাকে ভাবতে হবে।'
আমি ভাবছি, যেই মানুষটা এত গুলি বছর আমার সাথে রইলো, আমার জীবনটা সাজিয়ে দিলো তাকে আমি যেতে দেই কি করে? তার তো আমার সাথে আরো অনেক গুলি বছর কাটানোর কথা ছিলো।
আবার নতুন যেই সদস্য আমাদের মধ্যে আসতে চলেছে যাকে নিয়ে আমাদের এত স্বপ্ন তাকেই বা কি করে যেতে দেই? ওর জন্য দোলনা, জামা কাপড় সব আগে থেকেই কিনে রাখা হয়েছে। ওকে ছাড়া বাড়িতে গেলে এসব জিনিস গুলো দেখে ওর কথা মনে পড়বে না বল?
আমি ভাবছি আর হাসপাতালের করিডোরে পায়চারী করছি।
আবার ডাক্তার আসলেন। এবার অনেকটা ধমকের স্বরেই বললেন,
'কি হলো, বলছেন না কেন আমরা কাকে বাঁচাবো? আপনি কি চান দুইজনেই মারা যাক?'
আমি কাঁপা গলায় বললাম, 'আমি জানিনা। আমার পক্ষে যেকোনো একজনকে বেছে নেয়া সম্ভব না।'
কিছুটা বিরক্ত ভাব নিয়ে তিনি আবার চলে গেলেন।
আমার মাথায় আবার চিন্তা ঘুরছে। আমি কি ছোট্ট ছোট্ট হাতটা বেছে নিবো নাকি যেই হাত সবকিছু ছেড়ে আমার হাত ধরেছিলো তাকে বেছে নিবো।
কিছুক্ষণ পর আবার ডাক্তার আসলেন। একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। যেই কান্নার আওয়াজ শুনার জন্য আমি আর রুপালি এতদিন অপেক্ষা করে ছিলাম।
ডাক্তার আমার হাতে বাচ্চাটিকে তুলে দিতে দিতে বললেন,
'আপনাকে যেই প্রশ্নটা করেছিলাম সেটা এই বাচ্চাটির মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম৷ তিনি বাচ্চাকে বাঁচাতে বলেছেন। দুঃখিত আপনার স্ত্রীকে আমরা বাঁচাতে পারিনি।'
আমি বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে বসে পড়লাম। নার্স বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে বলল, 'সাবধানে। বাচ্চা পড়ে যাবে।'
আমি বাচ্চাটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এই বাচ্চাটির জন্য আমার স্ত্রী আমাকে ছেড়ে চলে গেলো।'
সেই বাচ্চাটি কে জানিস? সে হলো তুই। আমাদের দ্বিতীয় সন্তান। তোর একটা বড় বোন আছে।
সব রাগ গিয়ে পড়লো তোর উপর। আমার অনাদরে বড় হতে লাগলি তুই। আমার এই অনাদর পুষিয়ে দিলো তোর বড় বোন শীতল।
একদিন হঠাৎ শীতল তোকে আমার কাছে আনলো। আমার হাত টা তোর মাথায় রেখে বলল,
'বাবা, যে নেই তাকে তো আমরা ফেরত পাবো না। কিন্তু যে আছে তার প্রতি এত অনাদর কেন বাবা?'
সেদিন প্রথম বারের মত তোকে আমি জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদলাম।
একদিন বাড়িতে এসে দেখি আমার সেই শান্ত শিষ্ট মেয়েটা যে তার নামের মতই শীতল ছিলো সে আর নেই। অন্যদের থেকে যেটা জানতে পারলাম খেলতে খেলতে তুই পুকুরে পড়ে গিয়েছিলি। শীতল তোকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে আর বেঁচে ফিরতে পারেনি। ভিজা শার্টটা তোর গায়েই শুকিয়ে গেছে তখন। তোর জন্য আমার মেয়েটাও মারা গেলো। কিন্তু এবার আর তোর উপর রাগ হলো না। ঠিক করলাম, তোর মা আর বোনের ভালোবাসা আমি পুষিয়ে দিবো তোকে।
আচ্ছা, যখন গলায় দড়ি টা দিলি তখন তোর একবারও মনে হলো না এই তোকে বাঁচাতে গিয়ে আমার স্ত্রী আমার মেয়ে মারা গেলো। দুইটা প্রাণ তোর জন্যই ঝড়ে গেলো। কেন মনে হলো না? একটা বার কি ভেবে দেখা যেতো না....
নিজের ছেলের লাশের সামনে বসে এই কথা গুলোই বিলাপ পাড়ছিলেন মিঃ সাইদুল। তার বড় ভাই তার কাধে হাত রাখলেন।
সাইদুল কান্না মুছে বললেন,
-ইমাম সাহেব জানাজা পড়াতে রাজি হলেন ভাইজান?
-না। আত্মহত্যা করায় কেউই জানাজা পড়াতে রাজি হচ্ছে না। এই এলাকার সব ইমামদের কাছেই তো গেলাম। কেউ জানাজা পড়াতে রাজি হচ্ছে না।
-অন্য এলাকায় গিয়ে দেখি যারা ও আত্মহত্যা করছে এই সম্পর্কে জানেনা।
সাইদুলের বড় ভাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
-মাহিন লাইভে এসে ওই মেয়ের জন্য আত্মহত্যা করেছে, সাইদুল। ওর আত্মহত্যা পুরো দেশের লোকই দেখেছে। আর অনেক সাংবাদিকও বাসায় জড়ো হয়েছে। কারোর জানতে বাকি নেই। সবাই ওর মৃত্যুটার নাম কি দিয়েছে জানিস?
-কি?
-A live death..
দিনের বেলায়ও দরজা বন্ধ করে রাখা মাহিনের স্বভাব। সবসময়ের মত কালকেও দরজা বন্ধ করেই ছিলো।
মাহিনের বন্ধু দৌড়াতে দৌড়াতে আসলো। সাইদুল জিজ্ঞেস করলেন,
-কি হয়েছে? এভাবে দৌড়াচ্ছো কেন বাবা?
-আঙ্কেল, মাহিন আত্মহত্যা করেছে।
-কি...
মোবাইলটা সাইদুলের সামনে এগিয়ে দিলো সে। ভিডিও টায় মাহিনকে দেখা যাচ্ছে। গলায় ফাঁস পড়ে লটকে আছে সে। লাইভটা এখনো চলছে। লাইভ বন্ধ করার মানুষটা আর নেই। কি এমন দুঃখ ছিলো ওর?
মাহিনের বন্ধুটা বলল,
- আঙ্কেল, ও একটা মেয়েকে পছন্দ করতো। ওই মেয়েটার জন্যই...
সে আর কি বলে চলেছে সাইদুলের কানে যায় নি।
সাইদুল মাহিনের লাশটা কোলে তুলে নিলেন। অন্য জায়গায় খোঁজ করে দেখতে হবে। কোনো না কোনো ইমাম হয়ত জানাজা পড়তে রাজি হবে।
তিনি মাহিনের লাশ নিয়ে হাঁটছেন আর বিড়বিড় করে বলছেন, 'তোকে বাঁচাতে গিয়ে আমার স্ত্রী আর মেয়ে মারা গেলো মাহিন। তাদের তুই আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে দে। নয়ত তুই ফিরে আয় আমার কাছে।'
(সমাপ্ত)
অরণী_মেঘ
Comments (0)