কোথায় যেন বিজ্ঞানী নিউটনের একটা সুত্র পড়েছিলাম। সুত্রটা অনেকটা এরকম -
" কোনো বস্তুকে যেভাবে রাখা হয় বস্তু চিরকাল সেভাবেই থাকতে চায়। যতক্ষন পর্যন্ত না বাইরে থেকে বল প্রয়োগ করা হয় সে যেখানে যেমন আছে তেমনিভাবেই পড়ে থাকে। একে খুব সম্ভবত বস্তুর জড়তা বলে।"
তো আজকে সকালে ঘুম থেকে উঠে কম্বলের তলা থেকে বের না হয়েই এই থিওরি টা হটাৎ আমার মনে পড়ে গেলো। আসলেই তো! এত বড় একটা থিওরি আমি জানি কিন্তু কখনো এটা পরীক্ষা করে দেখিনি? ছ্যাহ! ধিক আমার উপর। না, না আর দেরি করা যায় না। আজকেই এই থিওরি পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
মন চাইছিলো না কিন্তু তবুও জোর করে নিজেকে কম্বলের ভেতর থেকে বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলাম ফ্রেশ হওয়ার জন্য। পাক্কা দু মিনিট টুথপেস্ট মাখানো ব্রাশ নিয়ে দাড়িয়ে রইলাম। মুখের মধ্যে ব্রাশ ঢোকানোর সাহস হচ্ছে না। এই মুসিবতে আমি প্রায় প্রতিদিনই পড়ি। ব্রাশ করার জন্য টুথপেষ্ট মাখিয়ে ব্রাশ নিয়ে অনেক্ষন দাড়িয়ে থাকি। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল শীতলতা তখন যেন এসে ভর করে আমার এই টুথব্রাশে। একে মুখে প্রবেশ করানোর সাহস টুকু সঞ্চয় করতে আমাকে অনেক বেগ পেতে হয়। নাহ, আজ আমাকে বিজ্ঞানী নিউটনের থিওরি পরীক্ষা করতে হবে। এত মহান একটা কাজের জন্য আমি সামান্য শীতলতা সহ্য করতে পারবো না, এ হয় না। এই ভেবেই ব্রাশ সোজা মুখের মধ্যে চালান করে দিলাম। খুব দ্রুত কাজ শেষ করে রান্নাঘরে চলে গেলাম। গপ-গপ করে কিছু খেয়ে সোজা চলে এলাম আমার পড়ার টেবিলের কাছে। একটা বোর্ড মতো বানিয়ে তাতে গোটা গোটা হরফে লিখলাম -
"বিজ্ঞানী নিউটনের বস্তুর জড়তার পরীক্ষা চলিতেছে"
ব্যাস, প্রাথমিক প্রস্তুতি সব শেষ। এবার নিজেকে একটা জড়বস্তু ধরে নিয়ে দ্রুত গিয়ে কম্বলের ভেতর সেধিয়ে গেলাম। উফ! যা শীত পরেছে এবার। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করতে বসেছি যেহেতু সম্পুর্ন মনযোগ ঢেলে দিয়ে কাজ করতে হবে। কাজে যেন একচুল ফাক না থাকে। তাই নিজেকে জড়বস্তু ভাবতে লাগলাম। আচ্ছা জড়বস্তুর বৈশিষ্ট্য কি? অনেকক্ষণ ভেবে কয়েকটা বৈশিষ্ট্য আমি বের করলাম -
১/ জড়বস্তু কথা বলতে পারে না
২/ জড়বস্তু হাটতে চলতে পারে না
৩/ জড়বস্তু খেতে পারে না
৪/ জড়বস্তু কোনোকিছু শুনতে পায় না
৫/ জড়বস্তু কোনো কিছুর ঘ্রানও পায় না
আপাতত এই কটা মেনে চললেই হবে। বাকি গুলো পরে দেখা যাবে। ঘরের সবাই বোধহয় উঠছে। এইবার খেলা জমবে!
মা প্রথমে আমার রুমে এলো। এসে যেই আমাকে ডাকতে যাবে তখনই তার চোখ পড়লো বোর্ডটার উপর। লেখাগুলো পড়ে ভ্রু কুচকে খানিকক্ষণ কি যেন ভেবে তারপর চলে গেলেন। আসলে মা আমার নিত্যকার নানা বিচিত্র কর্মকাণ্ডে অভ্যস্ত হয়ে গেছে তাই বেশি অবাক হলো না। কিছুক্ষণ ঠান্ডা দৃষ্টিতে লেখাটার দিকে তাকিয়ে থেকে চলে গেল।যাক অবশেষে মা আমার কাজের মাহাত্ম্য বুঝতে পেরেছে। আশাকরি আমাকে আর ডিসটার্ব করবে না। আমি মনের সুখে আমার কাজ করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর দেখলাম সবাই নাস্তা করতে বসেছে। আর বসেছে এমনভাবে যাতে আমি এখানে শুয়ে থেকেই তাদের দেখতে পারি। আর প্রতিদিনের মত একঘেয়ে নাস্তা আজ হচ্ছে না। বাইরে থেকে গ্রিলড চিকেন আনিয়েছে দেখলাম সাথে নান রুটি। মা আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে আপুকে বড় বড় মাংসের টুকরো গুলো মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। ভাবখানা যেন এই - "দ্যাখো বাছা, তোমার এই আতেল মার্কা কাজের জন্য তুমি আজ কি মিস করছো?"
আমি মনে মনে হাসলাম। তারা জানেও না সকালে আমি খেয়েছি। আর বিজ্ঞানের এই মহান পরীক্ষার জন্য আমি একদিনের সকালের নাস্তা ত্যাগ করতেই পারি। কিন্তু এই মূর্খদের তা বুঝাবে কে? এদের প্রতি আর নজর না দিয়ে আমি আমার পরীক্ষায় মনোনিবেশ করলাম। ওদিকে নাস্তা খেয়ে আপু অফিসে চলে গেলো। মা শীতল চোখে একবার আমার দিকে তাকিয়ে চলে গেলেন। ওনার প্রথম আক্রমণ আমার পরীক্ষাকে ভেস্তে দিতে পারেনি। উনি নিশ্চয়ই এবার দ্বিতীয় আক্রমণ করবেন। আমাকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
মনে মনে মার বিরুদ্ধে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু মার বদলে হটাৎ রুমে চলে আসলো বাবা। গটমট করে আমার দিকে মিনিট খানেক তাকিয়ে রইলেন। মানুষের চোখের দৃষ্টি দিয়ে যদি কারো ক্ষতি করা যেতো তাহলে এতোক্ষণে আমি জ্বলেপুড়ে ভস্ম, না না অনু পরমাণু হয়ে যেতাম। বাবার মতলব ঠিক বুঝতে পারছিনা। উনি আসলে করতে কি চাইছেন?
আমার প্রশ্নের জবাব মিললো পরমুহূর্তেই। বাবা মুখে একটা ক্রুর হাসি ঝুলিয়ে আস্তে করে গিয়ে রুমের ফ্যানটা ফুল স্পিডে ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেন। প্রচন্ড বাতাস বইতে লাগলো রুমে। এই শীতের মধ্যে এত ঠান্ডা সহ্য করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু না, বিজ্ঞানের খাতিরে এই কষ্ট আমাকে সহ্য করতেই হবে। কল্পনার চোখে দেখতে পাচ্ছি পত্রিকায় একদিন আমার এই মহান পরীক্ষার কথা ছাপা হচ্ছে। দেশ বিদেশে আমার নামডাক ছড়িয়ে পড়ছে। গুজব শোনা যাচ্ছে এবার নাকি নোবেল পুরষ্কারটিও বাংলাদেশে আসছে আমার বদৌলতে। ছেলের এত বড় প্রাপ্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বলে বাবা সেদিন কী লজ্জাটাই না পাবেন ভেবে খুব মজা লাগছে আমার। নিজেকে আরো ভালোভাবে কম্বলের ভেতরে সেধিয়ে নিলাম। আস্তে আস্তে টের পেলাম ঠান্ডা কমছে। ব্যাপার কী? বাবার কি তবে শুভবুদ্ধির উদয় হলো? কম্বলের তল থেকে মুখ বের করে কাউকে দেখতে পেলাম না। যাক এবার একটু শান্তিতে থাকতে পারব। কিছুক্ষণ এভাবেই শান্তিতে কাটলো। কিন্তু আমার মনে যেন কেমন খটকা লাগলো। বাবা এত সহজে আমাকে ছেড়ে দেবে ভাবতেই কেমন যেন লাগছে।
এসব যখন ভাবছি হটাৎ সশব্দে আমার রুমের দরজাটা খুলে। আর খোলা দরজা দিয়ে যারা ঢুকলো তাদের দেখেই আমার আত্মা শুকিয়ে গেলো। পাশের ফ্ল্যাটের রুনু, ঝুনু দুই পিচ্চি বোন। এরা যে কী লেভেলের দুষ্টু তা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। বিশ্বযুদ্ধের সময় এই দুইজন যদি হিটলারের বাহিনীতে থাকতো তাহলে সে নিশ্চিত যুদ্ধে জিতে যেত। এরা এমনই পাজির পাজি। এদের থেকে বাচার একমাত্র উপায় হচ্ছে এরা আমার উপর যত অত্যাচারই করুক না কেন কোনো প্রকার রিয়াকশন দেখানো যাবেনা। যদি বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়াও দেখাই তাহলে আর এদের থামানো যাবে না। নিষ্পাপ চেহারার দুই শিশু। প্রথমেই রুনু দৌড়ে আমার গায়ের উপর লাফ দিয়ে পড়লো। পড়বি তো পড় আমার পেটের উপর পা দিয়ে পড়লো। ব্যাথায় আমি চিৎকার দেই কিনা সেটা দেখার জন্য আগ্রহভরে দেখলাম সে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমিও কম সেয়ানা না। কোনোরকম বিকার দেখালাম না। যেমন আছি তেমন চুপটি করে শুইয়ে রইলাম। ঝুনু ততক্ষণে আমার সেলফের দিকে নজর দিয়েছে। উল্কার গতিতে ছুটে গিয়ে সেলফ থেকে কি একটা বার করে যেন নিয়ে এলো। ভালো করে দেখতে পাচ্ছি না। আমার সামনে এসে এবার জিনিসটাকে আমার মুখের সামনে তুলে ধরলো। ওর হাতে যা দেখতে পেলাম তাতে আমার বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। আমার মুসলমানির সময় আমার টিউশনের ম্যাম আমাকে একটা ছাপার লুঙ্গি দিয়েছিলো। এই লুঙ্গিটা আমার সবেধন নীলমনি। ওরা যদি আমার এই প্রানপ্রিয় লুঙ্গির কোনো ক্ষতি করে তবে আমি বাচবো না। আমার প্রিয় ম্যামের দেয়া একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন এটা! ঝুনু নিষ্ঠুরভাবে একটি কেচি আমার পড়ার টেবিল থেকে তুলে সেটা দিয়ে লুঙ্গিটা কেটে ফেলতে যাচ্ছে। একমনে প্রার্থনা করতে লাগলাম লুঙ্গির হেফাজতের জন্য।
মিয়াও!
মিয়াও!
আরেহ! আমার বিড়াল টুকুর ডাক না এটা? তাইতো মনে হচ্ছে! তবে কি আমার সাধের লুঙ্গি বেচে গেলো? রুনু ঝুনু বিড়ালকে জুজুর মতো ভয় পায়। টুকু কে দেখেই দুবোন ভো দৌড় দিলো। কীসের লুঙ্গি কীসের কি! যাক বাবা! এ যাত্রা বেচে গেলাম।
সারাদিন কোনোরকম ঝামেলা ছাড়াই কেটে গেলো। সন্ধ্যার দিকে দেখলাম আমার ক্লাসের একবন্ধু যার নাম হচ্ছে গিয়ে পাদু ইকবাল। ওর ভালো নাম ইকবাল হক। কিন্তু ব্যাটার পেটে গ্যাসের ব্যামো থাকায় সময়ে অসময়ে বিকট শব্দে বায়ুত্যাগ করে৷ আর সে কী পাদ! এটমিক বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজের সাথে প্রচন্ড দুর্গন্ধ। যার অভ্যেস নেই সে প্রথম দফা তেই জ্ঞান হারাবেই হারাবে। এই মহারথীর হটাৎ আমার বাসায় কেন আগমন তা বুঝতে পারছি না। বন্দুবান্ধব কারো বাসাতেই কখনো তাকে যেতে দেখা যায়না। আসলে সবাই তাকে কৌশলে এড়িয়ে যায়। মা দেখলাম পাদুকে আজ বেশ খাতির করছে। ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে বেশ অনেকক্ষন ধরে জামাই আদর করে দেখলাম ওকে আলুরচপ,বেগুনি,সিঙ্গারা,ঝালমুড়ি ইত্যাদি খাওয়ানো হচ্ছে। খাওয়া শেষ হলে মা ওর কানে কি যেন চুপি বললেন। তারপর দ্রুত আপুকে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন। কিছুই বুঝতে পারছিনা। হচ্ছেটা কী!
পাদুকে আমার রুমের দিকে আসতে দেখলাম। সে এসে চুপচাপ আমার ঝোলানো বোর্ড টার দিকে তাকালো। তারপর মুচকি একটা হাসি দিলো। তেলেভাজা খেয়ে খেয়ে দেখলাম ব্যাটার পেট ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। হটাৎ করে সে আমার দিকে উল্টো ঘুরে দাড়ালো। সর্বনাশ! ব্যাটার মতলব কি? আমি যা ভাবছি তাই যদি হয় তাহলে আমার আজ খবর আছে। আমার আশংকা মুহুর্তে সত্যে পরিনত হলো। পটাআআআআসসস!!! শব্দে বিস্ফোরিত হলো ওর পেটের গ্যাস। নারকীয় দুর্গন্ধে আমার প্রান বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। নিকুচি করি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার। লাফ দিয়ে কম্বলের তলা থেকে বেরিয়ে পাদু ইকবালের পাছায় সজোরে এক লাথি হেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেলাম বাড়ি থেকে। বেচে থাকলে বিজ্ঞানের চর্চা আরো করা যাবে, আগে জীবনটা তো বাচাই!
লিখেছেন : Ismail H. Polash
Comments (0)