- রাফসান তুমি কখন আসবে? আমার সন্ধ্যা থেকে পেটে হালকা ব্যাথা করছে।
- এসময় একটু আধটু হয়। আমার আসতে লেট হবে। অফিসে অনেক কাজ। ব্যস্ত আছি। রাখি।
বলেই ফোন রেখে দিল রাফসান। নিরা এই কদিন পর আট মাসে পড়বে। সন্ধ্যা থেকেই পেটে ব্যাথা করছে। তীব্রও হচ্ছে ব্যাথা। কিন্তু কাকে ডাকবে? ওদের বিয়ে হয়েছে ন মাস। প্রেমের বিয়ে ছিল। তাই বাবা মা মেনে নেয়নি। শ্বশুর বাড়িতেও ঠাঁই মেলেনি। উঠেছে একটা বাসায় পাঁচতলায়। ছাদের ছোট একটা চিলেকোঠার মতো বাসায়। রাফসানের স্বল্প খরচে দিব্যি চলছিল। প্রত্যেকদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে আসার সময় একগুচ্ছ কাঠ বেলি এনে ওর মাথার খোঁপায় গুঁজে দিতো। আজকাল আর দেয় না। প্রত্যেক সপ্তাহে একবার বাইরে নিয়ে যেত। আজ ওদের ভালোবাসার চিহ্ন নিজের মাঝে থাকায় ভয়ে বেরই হয় না। রাফসানও জোর করে না।
নিরার আবদারেই বাচ্চা নিয়েছে রাফসান। কিন্তু সময় যত গেছে তত নিরা বুঝতে পেরেছে ইচ্ছেটা কেবল ওরই ছিল। বাচ্চা নেওয়ায় বেশ মুটিয়ে গেছে ও। আগের সেই আকর্ষণীয় ফিগারটা আর নেই। এতে যদিও নিরার কোনো দুঃখ নেই কিন্তু রাফসানের মনোযোগ যে অন্য দিকে গেছে তা বুঝতে বাকি নেই নিরার। কি কাজে ব্যস্ত থাকে রাফসান সেটা ভেবে নিরার কতই বালিশ ভিজেছে তা কেবল ওই জানে।
দশটার দিকে চরম ব্যাথা উঠল। নিরা কেবল রাফসানকে ফোন দিয়ে চলল। ফোন বন্ধ। এদিকে ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে। সহ্য ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। বহুকষ্টে দরজা খুলে বের হলো নিরা। দাঁড়াতে পারছে না ব্যাথার চোটে। শেষ বার রাফসানকে ফোন করল। বন্ধ। কয়েক সিঁড়ি নামতেই তীব্র ব্যাথায় চিৎকার করে ওঠে। ওর চিৎকারে চার তলার ভারাটিয়ারা বের হয়ে আসে। নিয়ে যায় হসপিটালে।
ফোন বাজছে মোতাহের সাহেবের। রাত বারোটা ছুই ছুই করছে ঘড়িতে। এমন সময় কে ফোন দিল? অচেনা নাম্বার। রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে নিস্তেজ একটা কন্ঠ বাবা বলে ডেকে উঠল। কন্ঠ শুনে আত্মা কেঁপে উঠল তাঁর। তিনি দ্রুত বলে উঠলেন, নিরা মা, কি হয়েছে? অপর পাশ থেকে ছটফটরত নিরা বলে উঠল, বাবা, আমি মনে হয় বাঁচবো না। ও বাবা, আমার সন্তানকে বাঁচাও বাবা। বাবা……
নিরা আর কথা বলতে পারল না। ব্যাথায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে ধীরে ধীরে। একটুপরেই অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাবে ওকে। পাশে থাকা মহিলা ফোন নিয়ে বলল, আপনারা দ্রুত হাসপাতালে চলে আসুন। মহিলা থেকে হাসপাতালের ঠিকানা নিয়ে তড়িঘড়ি করে তৈরী হয়ে নিলেন। রাবেয়া বেগম জিজ্ঞেস করলেন, এত রাতে কোথায় যাচ্ছো?
- তোমার মেয়েকে বাঁচাতে।
রাত তিনটা। নিরার জ্ঞান ফিরেছে হালকা। পাশে তাকিয়ে দেখল রাবেয়া বেগম ওর হাত ধরে আছেন। মোতাহের সাহেব পাশের বেডে বসে আছেন চুপ করে। নিরা হালকা স্বরে ডাকলো, বাবা। মোতাহের সাহেব তড়িঘড়ি করে কাছে এসে বললেন, কি মা? নীরা শুধু একটা প্রশ্ন করল, আমার সন্তান? তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাথা নাড়ালেন। নিরার কেবল চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।
সকাল আটটায় ডাক্তার চেক আপ করতে এল। তখন জানতে পারলো আরো আগে আনলে হয়ত বাচ্চাকে বাঁচানো যেত। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। নিরা কিছু বলল না। গতকাল সকালে বের হওয়ার সময়ও রাফসানকে বলেছিল, কদিন ধরে পেটে ব্যাথা করছে। একটা চেক আপ করিয়ে আনতে। রাফসান হু হা করে বেরিয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার চলে গেলে নিরা মোতাহের সাহেবকে ডেকে বলল, বাবা, আমি বাড়ি যাবো। নেবে আমায়? তিনি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, নিশ্চয়ই নিয়ে যাবো। তুই একটু সুস্থ হয়ে নে। নিরা হালকা হাসলো, যাদের ছেড়ে দুই বছরের ভালোবাসাকে বেছে নিয়েছিল, তাঁরা আজ ওর পাশে।
ঘড়িতে ন'টা পয়তাল্লিশ। নিরা চোখ বুজে আছে বেডে। রাফসান এসে কেবিনের দরজা খুলল। ওর হাতের স্পর্শ পেতে নড়ে উঠল নিরা। নিরা হেসে বলল, এসেছো? ব্যস্ততা শেষ হয়েছে তাহলে!?
- আমাদের সন্তান……
- আমাদের! ওটা তো আমার সন্তান ছিল। মরে গেছে।
- নিরা……
- আজকে তোমার মুক্তি রাফসান। এতদিন আমার পুঁচকুটার জন্য তোমাকে বেঁধে রেখেছিলাম কষ্ট পাথর চাপা দিয়ে। পুঁচকুটা হয়ত বুঝতে পেরেছিল তাই আমার কষ্ট কমাতে ছেড়ে চলে গেছে।
- নিরা এসব কি বলছো?
- আমি সব জানি রাফসান। আগের মতো অন্ধ হয়ে নেই আমি। সব চোখে স্বচ্ছ পানির মতো দেখতে পাই। তোমার আর তোমার কলিগ রাহির সম্পর্কটা কতদূর গড়িয়েছে তা আমার জানা। কাল রাহির বাসায়ই তো ছিলে। ফোনে তোমাদের ফিসফিসে আলাপন কানে এসেছে। বড্ড ব্যস্ত ছিলে তাকে নিয়ে যে নিজের সন্তানের প্রতি পর্যন্ত সামান্য মায়া জন্মায়নি। তোমার গায়ের গন্ধ আমার চেনা রাফসান। প্রতিদিন শার্টে রাহির পারফিউমের গন্ধটা আমি ঠিকই পেতাম। কিছু বলিনি। সময় দিয়েছি। বদলাওনি। আমি সুস্থ হলেই ডিভোর্স লেটারটা পেয়ে যাবে। এখন আসতে পারো।
রাফসানের করুন চোখ ওর কষ্টের পাথর নড়াতে পারেনি। যে চোখের প্রেমে ও পড়েছিল সেই চোখ আজ অন্য নারীতে আসক্ত। রাফসান উঠে চলে গেল। নিরার বাবা মা চুপ করে কেবল ওদের কথা শুনে গেছেন। কিছু বলেননি। নিরার আজ প্রথম মনে হল, মিথ্যা ভালোবাসার মোহে পড়ে সেদিন বাবা মায়ের অবাধ্য হয়ে কতটা ভুল করেছিল!
একসপ্তাহে নিরা ডিভোর্স লেটারটা পাঠিয়ে দিল আর শপথ করে নিল, এবার থেকে বাবা মায়ের কথা শুনে চলবে। সেটাই করল। বাবা মায়ের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করল একমাস পর। এখন তাদের দুই বছরের ছেলে আছে। বেশ সুখেই আছে। তবু মাঝে মধ্যে রাফসানের কথা ভাবলে বুকটা ফেটে পড়ে রাগে, দুঃখে, ঘৃণায়।
সেদিন পার্কে হাঁটছিল তিনজন। তখনই একজনকে দেখে থমকে যায় নিরা। রাফসান, উশকো খুশকো চুল, মুখে দাড়ি গোঁফে ভর্তি, বনমানুষের মতো লাগছিল। নিরাকে দেখে এগিয়ে এসেছিল। চিনতে অসুবিধা হয়নি রাফসানের, ঠিক সেই আগের নিরা যাকে ও বিয়ে করেছিল। এগিয়ে এসে বলল, ভালোই আছো। নিরা হেসে বলল, তোমার মতো মোহে পড়িনি। ভালোবেসেছি। তাই ভালো আছি। বলে স্বামী সন্তান নিয়ে হাঁটা দিল।
আজকাল এই মিথ্যে মোহে পড়ে কারো বাবা মায়ের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয় তো কারো জীবন। আমরা এতটাই মোহে আবদ্ধ থাকি যে সত্যি আর মায়াজালের পার্থক্যটা করে উঠতে পারি না। এই পৃথিবীতে বেশিরভাগ ভালোবাসাটাই এখন কেবলমাত্র মোহ।
লেখনীতে : সাহেদা আক্তার
Comments (0)