Search

বাদলের দিন...

  • Share this:

'ভয় পাস নে মা, এইতো তো আমি এখানেই আছি।'

ঝড়-বৃষ্টি নামলেই মেয়েটা এত ভয় পায় বলার মতো না। বিশেষ করে যখন আকাশে বিদ্যুৎ চমকায় তখন সে পারলে তার বাবার বুকের মধ্যো ঢুকে যায় এমন অবস্থা!

ওর বাবাও পরম যত্নে মেয়েকে বুকের মধ্যো টেনে নেন। হেসে হেসে অভয় দেন, কপালে চুমু দেন।

রেহেনা বেগম এসব বেশি পছন্দ করেন না। তিনি ঈষৎ রাগও করেন বটে। রফিক মিয়া হেসে বলেন,

- তুমি এত রাগ হও ক্যান বউ?

- রাগ হমু না তো কি? মেয়ে যেন শুধু একা আপনারই আছে। ঝড়-বৃষ্টি দেখলে এত ডরানের কি আছে?

- ছোড মাইয়া, বড় অইলে সব ঠিক হইয়া যাইব...

রেহেনা বেগম আর কথা বলেন না। তার কথা বলতে ইচ্ছে করে না।

নিজের মেয়েকে যে তিনি ভালবাসেন না, তা না। শুধু ঝড়-বৃষ্টির এই সময়টা তিনি একটু অন্যরকমভাবে কাটাতে চান। তার মেয়ে নাহিয়ানের বয়স তিন বছর। যেখানে তাদের বিয়ের বয়স চার বছর।

এই সময়টাতে মেয়েটা যদি একটু ঘুমিয়ে থাকত বা তার দাদির কাছে থাকত তবে রেহেনা বেগম একটু শান্তি পেতেন! স্বামী রফিক মিয়াকে খুব একটা কাছে পান না তিনি। ছোটবেলা থেকে বিয়ের আগ পর্যন্ত গল্প-উপন্যাস পড়ে পড়ে বড় হয়েছেন রেহেনা বেগম। তার মনে এখনো রোমান্সের অভাব নেই। বয়সটাই বা কত হয়েছে, পচিশ ছাব্বিশ হবে হয়ত। এই বয়সে এখনো অনেক মেয়ের বিয়েই হয়নি। তিনি চান এই সময়টা অন্তত স্বামী-স্ত্রী একটু একান্তে কাটাক, সুখ-দুঃখের কথা বলুক, ভাল লাগা ভালবাসার কথা বলুক। সেটা সম্ভবপর হয়না। মেয়েটার জন্মের পর থেকে তার স্বামীর যেন তার প্রতি ভালবাসার টান পড়েছে। বাবা-মেয়ে দুজন দুজনার জন্য পাগল!

অথচ নাহিয়ান কে তিনিও ভালবাসেন। অন্যান্য মায়েরা যেমন ভালবাসে ঠিক তারথেকে বেশি তো কম নয়। শুধু এই সময়টাতে তার মনের ভিতরে দুটো অংশ হয়ে যায়। একাংশ মা আরেকাংশ স্ত্রী।

-

যেদিন নাহিয়ান পুকুরে ডুবে মারা গেল সেদিন বারেবারে মূর্ছা গেলেন রেহেনা বেগম। বারেবারে নিজেকে রাক্ষুসী মা বলে দাবী করলেন। নিজেই নিজেকে দোষারোপ করলেন তার মেয়ের মূত্যুর দায়ী হিসেবে। অথচ তার মেয়ের মূত্যুতে তার কোন হাত ছিল না। বাচ্চারা বাচ্চারা খেলাধুলা করতে করতে হঠাৎ করেই নাহিয়ান পুকুরে পড়ে যায়। তারপরে যা ঘটার তাই ঘটে। যতক্ষণে তারা পুকুরের কাছে পৌছায়, নাহিয়ানকে পুকুর থেকে উঠিয়ে আনে ততক্ষণে সে আর এই পৃথিবীতে নেই। রফিক মিয়া যেন হঠাৎ করে কান্না করতে ভুলে যান। তিনি পাথরের মূর্তির মত মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে থাকেন।

এরপর থেকেই মূলত রফিক মিয়ার মাথায় সমস্যা দেখা দেয়। ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলেই সে দৌড়ে মেয়ের কবরের কাছে গিয়ে দাড়ায়। তারপরে মাটিতে ঠেস দিয়ে বসে বলেন,

- 'ভয় পাস নে মা, এইতো আমি এখানেই আছি!'

তারপরে সারাটা বৃষ্টির সময় ধরে তিনি কবরের পাশে বসে থাকেন। কারো কোন কথা শোনেন না। রেহেনা বেগম বারান্দায় গালে হাত দিয়ে বসে থাকেন। এখন আর তার মনে রোমান্স খেলা করে না।

পরিচিত লোকজনেরা বলাবলি শুরু করল, 'রফিক মিয়ার চিকিৎসা দরকার! এভাবে আর কতদিন? মেয়ের মূত্যু শোক এবারে ভুলে যাওয়া উচিত।'

কেউ কেউ বুদ্ধি দিল এ বাড়ি ছাড়তে হবে। বেশকিছুদিনের জন্য অন্য কোথাও থাকলে হয়ত রফিক মিয়া এই কষ্টটা ভুলে যেতে পারবেন। তাই রেহেনা বেগম স্বামীকে নিয়ে আশ্রয় নেন তার নিজ পিত্রালয়ে। প্রথম প্রথম রফিক মিয়া একটু পাগলামী করলেও ধীরে ধীরে সুষ্ঠু হয়ে উঠেন তিনি। সেখানেই জন্ম হয় তাদের দ্বিতীয় সন্তান। একটা ছেলে। ছেলে হওয়াতে রফিক মিয়া বিশেষ খুশি হন না। তিনি আবারো একটা মেয়েই আশা করেছিলেন।

প্রায় দেড় বছর পরে আবারো নিজের বাড়িতে ফেরেন রফিক মিয়া। সবকিছু মোটামুটি স্বাভাবিকই মনে হয়। যতদিন না আবারো বৃষ্টির দিন শুরু হল ততদিন সবকিছু ভালোই ভালোই চলছিল। তারপরে হঠাৎ আবার সেই পুরনো রোগ ফিরে পায় তাকে। বৃষ্টি নামলেই তিনি তার মেয়ের কবরের পাশে যান। গিয়ে বসে থাকেন। মাঝেমধ্যো বিড়বিড় করে মেয়ের সাথে কথা বলেন। রেহেনা বেগম এখন আর কিছু মনে করেন না। লোকটা যদি এভাবে একটু শান্তি পায় তবে ক্ষতি কি?

সেদিন দুপুর বেলা ঝুম বৃষ্টি নেমেছিল। হঠাৎই খবর এল রফিক মিয়া মারা গেছেন পানিতে পড়ে! এটাও কি সম্ভব? এতবড় মানুষ, তারথেকে বড় কথা তিনি সাতার জানেন। অদ্ভুত ব্যাপার হল তার মেয়ে যেই পুকুরে পড়ে মারা গিয়েছিল ঠিক সেই পুকুরের সেই যায়গায়ই পড়ে মারা যান রফিক মিয়া। প্রকৃতিতে হাজারো অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, সব ঘটনার মানে খুজে পাওয়া যায় না। তেমন সেদিন রফিক মিয়ার মূত্যুটা ঠিক আত্মহত্যা কিনা নাকি অন্য কোন কারণ লুকিয়ে আছে এর পিছনে তা খুজে পাওয়া যায়নি।

পূর্ব অসিয়ত মতে তার মেয়ের কবরের পাশেই তাকে কবরস্থ করা হয়।

এখন আর বৃষ্টির দিনে রোমান্স খেলা করে না রেহেনা বেগমের মনে। বয়সটা নেহায়েতই কম হয়নি তার। ঊনষাট শেষে ষাট ছুই ছুই করছে। তার ছেলেটাও অনেক বড় হয়েছে।

এখন বৃষ্টি নামলেই কবর দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনি। দেখেন বাবা-মেয়ে একসাথে রয়েছে। রফিক মিয়া তার মেয়েকে অভয় দিয়ে যাচ্ছেন,

'পাগলী কোথাকার! এখন তুই কত বড় হয়েছিস। এখনো কি তোর ভয় পাওয়া সাজে?' এই বলে তিনি তার মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বুকে জড়িয়ে নেন। রেহেনা বেগমের চোখ ভিজে যায়। তিনি এমন ভালবাসা সহ্য করতে পারেন না। মনে মনে ভাবেন মেয়েটার প্রতি ভীষণ অন্যায় করেছেন তিনি! এমন দিনে তার ভীতু মেয়ের পাশে থাকা উচিত। বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলা উচিত, 'এইতো মা, আমি এখানেই। ভয়ের কিছু নেই'।

তার ছেলে পাশে দাড়িয়ে বলে,

- মা তুমি কাদছ কেন?

রেহেনা বেগম বলেন,

- বাজান, আমি মারা গেলে তোর বোনের কবরের পাশে কবর দিস...

#সমাপ্ত

 

[আপনার পরিবারে বাচ্চা ছেলে-মেয়ের খেয়াল রাখবেন। বিশেষ করে যারা সাতার জানে না]

🖋️Ovronil Adi

Tags:

About author
আমি গল্প এবং বই প্রেমিক একজন মানুষ। গল্প এবং বই পড়তে খুবই ভালোবাসি। যেখানেই যে গল্প অথবা কাহিনী খুজে পাই সেগুলো সংগ্রহ করি এবং আপনাদের সাথে শেয়ার করার চেষ্টা করি। আমি নিজেও কয়েকটি গল্প লিখেছি তবে সেগুলোর সংখ্যাটা খুবই সামান্য।