তখন প্রাইমারিতে পড়ি। ঠিক কোন ক্লাসে মনে নেই। সেই সময় আজিমপুর কলোনিতে আমাদের বাসার একটি রুম সাবলেট ভাড়া দেয়া হতো। আব্বার কঠিন নিয়ম মানতে না পেরে প্রায়ই ভাড়াটিয়া বদল হতো। এমনই এক সময় আমাদের বাসায় খোকন মামা ভাড়াটিয়া হয়ে এলেন।
তিনি আমাদের মামার বাড়ি সম্পর্কিত মামা। আমাদের খুব স্নেহ করতেন। তার ছিল একটি দাবা খেলার কোর্ট। এই খেলাটি একটু জটিল বলে তখনো এটি শেখা হয়নি। মামাও খেলার সাথী পাচ্ছেন না বলে একদিন সময় করে আমাকে খেলা শেখাতে বসলেন।
পড়াশোনা শেখার আগ্রহে ঘাটতি থাকলেও খেলা শেখায় প্রতি আমার আগ্রহ ছিল প্রবল। তাই খুব অল্প সময়েই আমি খেলাটি শিখে ফেললাম।
সোলজার প্রথমে এক বা দুই ঘর সামনে যেতে পারে, পরে এক ঘর করে। খাবে কোনাকুনি। পেছনে আসতে পারবে না। নৌকা যাবে সোজা। হতি কোনাকুনি। মন্ত্রী সোজাও যাবে আবার কোনাকুনিও। ঘোড়া আড়াই ঘর। এই ঘোড়ার আড়াই ঘর হিসাব করাটাই যা একটু জটিল। তাছাড়া বাকি সব খুব সহজেই আয়ত্ত করে ফেললাম।
খেলা শিখে এবার খেলতে শুরু করলাম। প্রতিপক্ষ তো মামাই। প্রথম গেম অল্প কয়েক চালে হেরে গেলাম। দ্বিতীয় গেম আরেকটু দীর্ঘায়িত হলেও হেরে গেলাম।
তৃতীয় গেমে এসে আমি মামাকে হারিয়ে দিলাম। মামা তো আকাশ থেকে পড়লেন। সদ্য খেলতে শেখা দাবাড়ুর কাছে তিনি হেরে গেছেন, এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। ওনার চেহারা পাংগু বর্ণ হয়ে গেলো। এমন পরাজয় তিনি কিছুতেই হজম করতে পারছিলেন না।
তিনি তাড়াতাড়ি আরেক গেম খেলার জন্য গুটি সাজালেন। এ গেমে প্রচুর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলেও আমি হেরে গেলাম। কিন্তু মামা এখন আমাকে শক্ত প্রতিপক্ষ ভেবে খেলায় আনন্দ খুঁজে পেলেন। তাই এরপর থেকে নিয়মিতই মামার সাথে খেলা হতে থাকলো।
আমাদের এ খেলার দর্শক হিসেবে ভাইয়া ও আম্মাও খেলা শিখে গেলেন। তবে আম্মা ঘোড়ার চালে প্রায়ই তালগোল পাকিয়ে ফেলতেন। আড়াই ঘর হিসাব করতে গিয়ে ঘুরে ফিরে আগের ঘরেই ঘোড়াটাকে রাখতেন।
তবু খেলোয়াড়ের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় আমাদের ঘরে দাবা খেলার চর্চা উত্তরোত্তর বাড়তে লাগলো। মামার সাথে আমার খেলা কিছুদিন সমানে সমানে হলেও, বেশিদিন এই সমান সমান অবস্থান স্থির থাকলো না। এরপর থেকে তিনি নিয়মিতই আমার কাছে হারতে লাগলেন। ক্রমাগত হারতে হারতে শেষে তিনি আমার সাথে খেলার উৎসাহ হারিয়ে ফেললেন। মামা আমাদের বাসা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার সময় আমাকে দাবার কোর্টটি দিয়ে গেলেন।
ইতোমধ্যে আমার খেলার দক্ষতা বন্ধু মহল ও আশেপাশে ছড়িয়ে পড়লো। কেউ একটু ভালো খেললেই তার সাথে খেলার আগ্রহ বেড়ে যেতো। দাবা খেলাটা অন্য সব খেলা থেকে আলাদা। বুদ্ধিতে কাউকে হারিয়ে দিতে পারার মজা অন্য রকম। এ আনন্দ বোঝানো যাবে না। আবার বুদ্ধিতে হেরে গেলেও কষ্টটা অন্য রকম। মনে মনে জেদ চেপে যেতো। মনে হতে থাকে, তাকে হারাতেই হবে। যতক্ষণ না হারানো যায়, ততক্ষণ কষ্টটা বয়ে বেড়াতে হয়।
এর মাঝে রাণী হামিদের বই কিনে দাবা খেলার প্রাথমিক কিছু নিয়মকানুন শিখে নিলাম। এখন আমি দাবার চাল লিখে রাখতে পারি। আবার লিখে রাখা খেলা দাবার কোর্ট এ সাজিয়ে খেলতেও পারি।
সেই সময়ে জনকণ্ঠ পত্রিকায় বিশ্বের কিছু নামি-দামি খেলোয়াড়দের খেলা ছাপা হতো। মাঝে মাঝে ঐ খেলাগুলো বোর্ডে সাজিয়ে খেলতাম। সেই খেলাগুলো খেলে হতভম্বই হয়ে যেতাম। এমনও দেখেছি, একজন বোকার মতো তার মন্ত্রী খাইয়ে দিয়েছেন। আমি ভাবতাম, এমন বোকা আবার গ্রান্ড মাস্টার হলো কিভাবে? অথচ কয়েক চাল পরেই যখন সে সেই খেলায় জিতে যেতো, তখন বুঝতাম, আসলে তাদের তুলনায় আমিই ভীষণ বোকা।
তখন কলেজে পড়ি। একটি টুর্নামেন্ট খেলার জন্য দাবা ফেডারেশনে নাম লিখিয়ে ফেললাম। যতদূর মনে পড়ে, সেটি ছিল "মহানগর দাবা"।
সম্ভবত আমার নামে ফেডারেশনে কোন রেঙ্কিং দাবাড়ু ছিলেন। নামে নামে জমে টানে জানি। তাই আমাকেও তেমনই একটা টান দিলো। সে হিসেবে আমার প্রথম খেলাটি পড়লো একজন আন্তর্জাতিক মাস্টার ছুঁই ছুঁই খেলোয়াড়ের সাথে। তিনিও ভেবেছেন, আমি রেটিং প্লেয়ার। খেলার শুরুতেই বুঝে গেলাম গলির মোড়ে ক্রিকেট খেলা আর জাতীয় পর্যায়ে খেলার মাঝে কতোটা ফারাক।
যাই হোক, আমার প্রতিপক্ষ তো আর জানে না যে, আমি গলির মোড়ের খেলোয়াড়। তাই তিনি খুব সতর্ক হয়ে খেলছিলেন। আমি মোটামুটি ভালো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রতিপক্ষের ঘাম ঝরিয়ে হেরে গেলাম।
দ্বিতীয় খেলাটি ছিল আমার জীবনের স্বরণীয় একটি খেলা। খেলাটি ছিল স্কুল পড়ুয়া একটি বাচ্চা ছেলের সাথে। শুরুতে আমি ভেবেছি, এই বাচ্চা ছেলেকে আমি ফু দিয়েই উড়িয়ে দেবো।
কিন্তু আমি কী জানতাম, সে ছেলে ফেডারেশনে এসে খেলা শেখে? আমি কী জানতাম তার কিছু স্বতঃসিদ্ধ চাল মুখস্থ আছে? দাবা খেলতে হলে যে স্বতঃসিদ্ধ চাল মুখস্থ করতে হয়, তা-ই তো আমি জানতাম না। তাই ঘটনা ঘটেই গেলো। আমার একাধিক পাওয়ার ও মন্ত্রী খেয়ে সে আমাকে মোটামুটি পথে বসিয়ে দিল। আর আমি নির্লজ্জের মতো তাকে দুই দুইবার খেলা ড্র করার অফার দিলাম। দ্বিতীয় বার ড্রর অফার দেয়ার পর সে আমাকে হুমকি দিল, আবার যদি আমি ড্রর অফার দেই তবে সে আমার নামে ফেডারেশনে কমপ্লেইন করবে।
কি আর করা, এইটুকুন ছেলের কাছ থেকে পাওয়া চরম অপমান সহ্য করে খেলা চালিয়ে যেতে লাগলাম। একটুখানি ভরসা ছিল যে, আমার দুটো ঘোড়া আর একটি নৌকা তখনো অক্ষত আছে। আর আমি ঘোড়ার চাল খুব ভালো দিতে পারি।
সে আমাকে আক্রমণ করতে করতে পুরোপুরি খাদের কিনারায় নিয়ে এলো। এক বা দুই চাল পরেই আমাকে ম্যাট করে দেবে। ঠিক সেই সময়ে আমি দুই ঘোড়ার চক্করে ফেলে তার খেলা শেষ করে দিলাম।
ঘটনার আকস্মিকতায় ছেলেটি প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেলো। ঘটনা কী ঘটেছে তা যেন বুঝে উঠতে পারলো না। তারপর সম্বিত ফিরে পেয়ে ঝর ঝর করে কাঁন্না শুরু করে দিলো। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে। মাঝে মাঝে হেঁচকি উঠে যাচ্ছে। তার কান্না দেখে অন্যান্য টেবিলের অনেক খেলোয়াড় তাদের খেলা ফেলে রেখে তার পাশে এসে দাঁড়ালো। এর মাঝেই সে কাঁপা কাঁপা হাতে প্রচণ্ড কষ্টে রেজাল্ট শিটে স্বাক্ষর করলো। এমন কান্না দেখে আমারও খুব খারাপ লাগতে লাগলো। মনে হচ্ছিলো, এ খেলায় না জিতলে তো আমার এমন কোন ক্ষতি হতো না। কিন্তু এখন এ কান্না কেমন করে থামাই?
যতদূর মনে পড়ে সেবার সে প্রতিযোগীতায় আমি পাঁচশ জনের মধ্যে একশ আঠাশ তম হয়েছিলাম। প্রথমবার অংশ নিয়ে এতোটা সাফল্য পাবো, আশা করিনি। পরে ফেডারেশনে আরো একটি টুর্নামেন্ট খেলেছিলাম। সেখানেও মোটামুটি সম্মানজনক সাফল্য এসেছিলো।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, বেশি মনোযোগ দিয়ে দাবা খেললে, মাথার উপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে। রাতে ঘুমাতে পারি না। ঘুমের মধ্যে দাবার গুটি ঘুরাঘুরি করে। দাবা খেলায় অনেকগুলো চাল এডভান্স চিন্তা করতে হয়। অর্থাৎ আমি একটি চাল দেয়ার পর আমার প্রতিপক্ষ কোন চালটি দেবে? তারপর আমি কোনটি দেবো? তারপর সে কোনটি দেবো? তারপর আমি কোনটি? তারপর সে কোনটি? এভাবে যে বেশি চিন্তা করতে পারবে, সে-ই ভালো খেলবে ও প্রতিপক্ষকে নিজের ছকে নিয়ে আসতে পারবে।
এতো চিন্তা করতে গিয়ে আমি প্রায়ই রাতে ঘুমের মধ্যে দাবা খেলতাম। শান্তি মতো ঘুমাতে পারতাম না বলে প্রায়ই মাথা ব্যাথা হতো। আবার প্রতিপক্ষ শক্ত হলে এ খেলায় অনেক সময় ব্যয় হতো। এমনও হয়েছে, এক খেলা আমি একদিনে শেষ করতে পারিনি। তাই শেষ পর্যন্ত এ খেলাটি ছেড়েই দিলাম। মাঝে মাঝে অকেশনালি খেললেও সিরিয়াস খেলাটা একদম ছেড়ে দিলাম। নাহলে হয় তো এতোদিনে একটা কিছু হয়ে যেতে পারতাম।
তবে দাবা খেলা ছেড়ে দিলেও এডভান্স চিন্তা করার বিষয়টি আমার মাঝে রয়ে গেলো। কোন মানুষকে কোন কথাটি বললে সে কোন কথাটি বলবে? তারপর আমি কোনটি বলবো? তারপর সে কোনটি বলবে? তারপর আমি কী বলবো? এ রকম একটি দক্ষতা নিজের মধ্যে তৈরি হয়ে গেলো।
মাঝে মাঝে বিভিন্ন প্রয়োজনে আমি এ কৌশলটি কাজে লাগানোর চেষ্টা করি। প্রয়োজনে, নিজের মতামতই অন্যের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করি। এতে কাজও হয়। তিনি ভাবেন, তার মতামতই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর আমি তো জানি, ঘটনা কীভাবে ঘটলো। এতে তিনিও খুশি আমিও খুশি।
জীবনের পরতে পরতে রয়েছে কতো রকমের শিক্ষা! এ শিক্ষাকে রপ্ত করে জীবনের প্রয়োজনে কাজে লাগাতে পারলে জীবনটাই অনেক সুন্দর হয়ে যায়।।
আবদুল্লাহ আল মামুন
রচনাকাল - ০৬ এপ্রিল ২০২১
Comments (0)