Search

আমাদের_একদিন(ছোটগল্প)

  • Share this:

আব্বুর ইচ্ছে হয়েছে নৌকা ভ্রমনে যাবেন।তাও আবার সপরিবারে।রাতে খেতে বসে বেশ আয়েশ করে কথাটা তুললেন।আব্বুর কথায় আমরা তিন ভাইবোন একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম।কিন্তু আব্বু নির্বিকার ভাবে মাছের মুড়োতে কামড় বসালেন।বড়ো আপুর মুখভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে বিরক্তির আভাস ফুটে উঠলো।ভাইয়া খুশি খুশি মুখে জিজ্ঞেস করলো,

--" কবে যাচ্ছি আব্বু?

--" আগামী শুক্রবার।

ভাইয়া বিস্তর খুশি হয়েছে তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।এতোক্ষণ আম্মু সামনে ছিল না।গরম ডালের বাটিটা টেবিলে রেখে প্রশ্ন তুললো,

--" কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি?

--" নৌকা ভ্রমনে যাব ভাবছি,মেঘনা নদীতে।

আব্বু একগাল হেসে উত্তর দিলেন।কিন্তু আব্বুর হাসিমুখে বলা কথাটা শুনে আম্মুর মুখটা অগ্নিমূর্তি ধারন করল।মুখ ঝামটা মেরে বললো,

--" তোমার ইচ্ছে হলে তুমি যাও।আমি বা আমার ছেলেমেয়ে কেও যাব না।

আম্মুর এহেন কথা শুনে আব্বুর চমকে উঠে রেগে যাওয়ার কথা ছিল।কিন্তু আব্বু রাগলেন না।আবারও হেসে বললেন,

--" আহা রাগ করছ কেন?দেখ অনেকদিন কোথাও ঘুরতে যাইনি।তাই ভাবলাম সবাই মিলে কোথাও ঘুরে আসি।

--" তাই বলে এই ভরা বর্ষায় নদীতে নৌকাভ্রমণ?

--" ভরা নদীর বুকে ভেসে বেড়ানোর মজাই আলাদা।

আব্বু স্মৃতিচারণ করে গল্প বলা শুরু করতেই আম্মু টেবিল ছেড়ে উঠে গেলেন।ভাইয়াও হাই তুলতে তুলতে তার রুমের দিকে এগুলো।"আমার পড়া আছে" বলে আপুও চলে গেল।আব্বুর সামনে আমি একাই বসে আছি।আব্বু চোখ বন্ধ করে আমাকে বলতে শুরু করলো,

--" জানিস মীরা,ছোটবেলায় আব্বা নদীতে মাছ ধরতেন।আমরা চার ভাই আব্বার পায়ের সাথে ঝুলে থাকতাম যাওয়ার জন্য।কিন্তু আব্বা বকে ধমকে বাড়ি ছেড়ে যেতেন।মাঝেমধ্যে বেতের বারিও পড়ত পিঠে।তবুও কান্নাকাটি ছিল নিত্য দিনের অভ্যাস।শেষে একদিন আমাদের যন্ত্রনায় অতিষ্ঠ হয়ে বাড়ির পেছনের ডোবায় নামিয়ে দিলেন।আমাদের খুশি দেখে কে।মাছ ধরা শিকেয় তুলে কাদা মাখামাখিতে মেতে উঠেছিলাম।পাশের বাড়ির মজনু চাচার ছেলে এসে আমাদের সাথে জুটেছিল।আহা কি যে আনন্দ।আব্বা আম্মার হাজার ধমক উপেক্ষা করে একে অপরের গায়ে কাঁদা ছুড়ছিলাম।অবশেষে শিং মাছ এসে তার ধারালো হুল ফোটালো আমার পায়ে।গগন বিদারী চিৎকার দিয়েছি।আমার চিল্লানো শুনে বাকিরা ডোবা ছেড়ে উঠে গেল।আর আমি ওখানেই পা চেপে বসে পড়লাম।আব্বা নেমে আমাকে উঠালেন।ব্যথায় সেদিন রাতে জ্বর এসে গেল।টানা সাতদিন ভুগিয়ে বিদায় নিল মারমুখো জ্বর।কোনদিন আর ডোবামুখো হইনি।সেদিন থেকে আমাদের এলাকায় ছোট বাচ্চাদের খাওয়ানোর সময় তাদের মায়েরা বলত "ঐ বাড়ির আশরাফকে শিং মাছে গুঁতো দিয়েছে।না খেলে তোদেরও দেবে"। বাচ্চাগুলো চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে থেকে ভাত খেয়ে নিত।কিছুদিন পর আমাকে রাস্তায় দেখলে বলত শিং মাছ চাচা আসছে।ব্যাস পাড়ায় আমার নাম রটে গেল শিং মাছ।শিং মাছ চাচা,শিং মাছ মামা,শিং মাছ ভাই,সমবয়সীরা শুধু শিং মাছ বলে ডাকত।গল্প বলতে বলতে আব্বু উচ্চস্বরে হাসছিলেন।আব্বুর মুখে এই গল্প কম করে হলেও কয়েকশ বার শুনেছি আমরা।তাই এখন এসব কথা তুললেই আম্মু,আপু,ভাইয়া পালানোর পথ খোঁজে।কিন্তু আমি শুনি,মনোযোগ দিয়েই শুনি।মাঝেমধ্যে এটা ওটা জিজ্ঞেস করি যেন মনে হয় গল্পটা প্রথমবার শুনছি।আব্বুও তুমুল উৎসাহ পেয়ে বলতে থাকেন।একদিন আপু আমাকে ডেকে রীতিমতো শাসিয়ে দিয়েছে।আব্বু কখনও ওসব গল্প শুরু করলে আমি যেন তাল না মেলাই।তাইলে আস্তে আস্তে ভুলে যাবে।কিন্তু আমি আপুর হুমকি এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দিয়েছি।

মেঘনা নদীর পাড়ে বিশাল একটা ছইওয়ালা নৌকা বাঁধা।বয়স্ক মাঝি নৌকার মেঝেতে পাটি বিছিয়ে ঠিকঠাক করছেন।আব্বু ওনাকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেলেন।আম্মু নদীর ঘাটে পানি নিতে আসা একজন মহিলার সাথে গল্প জুড়েছেন।সেদিন রাগ করলেও আব্বু কিভাবে যেন আম্মুকে রাজি করিয়ে ফেলেছেন।আপুর হাতে হূমায়ুন আহমেদ এর বই " বাদল দিনের দ্বিতীয় কদম ফুল"।আপু বইপোকা মানুষ।যেখানে যায় পার্স ব্যাগে একটা বই থাকবেই।ভাইয়া ক্যামেরা হাতে বিভিন্ন দৃশ্য ফ্রেমবন্দী করছে।ভাইয়ার ইচ্ছে প্রোফেশনাল ফটোগ্রাফার হবে।যেকোনো পরিস্থিতিতে সে ক্যামেরা হাতে প্রস্তুত হয়ে যায়।মাঝি কাকু তাড়া দিলেন নৌকায় উঠতে।আমরা একে একে নৌকায় উঠলাম।আব্বু আম্মুকে ডেকে তড়িঘড়ি করে নৌকায় উঠালেন।নৌকা চলতে লাগলো নদীর বুক চিড়ে।আকাশে মেঘ জমে আছে।যখন তখন বৃষ্টি নেমে আসবে।আব্বু কাঠের পাটাতনে দাঁড়িয়ে দু-হাত দু'দিকে ছড়িয়ে দিলেন।হঠাৎ ভাইয়া বলে উঠলো,

--" আম্মু,আব্বুর পাশে গিয়ে দাঁড়াও।তোমাদের একটা ছবি তুলি।

ভাইয়ার কথায় আম্মু লাজুক হেসে আব্বুর পাশে এসে দাঁড়ালো।ভাইয়া বেশ কিছু ছবি তুলে নিয়েছে।আম্মু ব্যাগে করে কমলা আপেল সহ বাহারী খাবার নিয়ে এসেছেন।আমি একটা আপেল নিয়ে চিবোতে লাগলাম।নদীর একপাশের গ্রামগুলো দেখা যাচ্ছে।বিশাল নদী হওয়ায় অপর পাশটা শুধু কুয়াশার মত লাগছে।মনে হচ্ছে ধবধবে সাদা খাতায় কালো রঙের দাগ দেয়া।মাঝেমধ্যে পাশ দিয়ে দু'একটা ট্রলার ছুটে যাচ্ছে।কি বিদঘুটে আওয়াজ।আপুকে দেখলাম বই বন্ধ করে উদাস হয়ে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে।ভাইয়াও ক্যামেরা ফেলে রেখে নৌকার গলুইয়ে বসে পানিতে পা ডুবিয়ে দিয়েছে।আমাকে ডেকে বললো,

--" মীরা এখানে পা ভেজাবি আয়।

--" না ভাইয়া আমার ভয় করে।

ভাইয়া হেসে আমাকে গাধী উপাধি দিয়ে নিজের কাজে মন দিয়েছে।আব্বু আর মাঝি কাকু রাজ্যের গল্প নিয়ে আসর জমিয়েছেন।তাদের গল্পের টপিকে রয়েছে পুরোনো দিনের জীবনযাত্রা,রাজনীতি এমনকি বাদ যাচ্ছে না আপুর বিয়ের পাত্র খোঁজার কথাও।আম্মু ছুড়ি দিয়ে ফল কেটে তাদের দিকে এগিয়ে দিল।

দুপুরের খাওয়াদাওয়া মাঝ নদীতেই সেরেছি আমরা।কাকুর নৌকা যেন আস্ত একটা সংসার।তার ওপর আমার মা সাথে করে নিয়ে এসেছে আরো একটা সংসার।সব মিলিয়ে হয়ে গেল খিচুড়ি আর ডিম ভূনা।বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পরছিল।ছইয়ের নিচে গাদাগাদি করে বসে খাওয়াদাওয়া করেছি।আপুও তার বিরক্তি ভুলে বেশ মজা করেছে।বিকেল গড়াতেই আব্বু ফেরার তাড়া দিলেন।নৌকা ফিরে চললো ফেলে আসা চেনা পথ ধরে।ফেরার সময় আপু এসে কানে কানে বললো,

--" এতো সুন্দর একটা দিন উপহার দেয়ার জন্য আব্বুর পুরোনো গল্প আরও একবার শোনাই যায়।

আপুর কথায় শব্দ করে হেসে ফেললাম আমি।নৌকায় থাকা সবার দৃষ্টি পড়ল আমার ওপর।আমি আব্বুকে ডেকে বললাম,

--" আব্বু,আপু তোমার শিং মাছ হওয়ার গল্পটা আবার শুনতে চাইছে।

আব্বু চমৎকার হাসি দিয়ে গল্প বলায় মনোযোগী হলেন।হঠাৎই মনে হল আকাশে মেঘের ফাঁকে একটুকরো রোদ ঝিলিক দিয়ে উঠলো।সত্যি জীবনটা মন্দ নয়।

সমাপ্ত

 

নিমিশা জান্নাত

Tags:

About author
StorialTech is an admin of this multi-platform website. StorialTech shares stories, tutorials, web templates, pdf books, and movies for you to easily access anything related to this website.