আমি সবেমাত্র অনার্স থার্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট। ভালোবাসার মানুষটাকে হারাতে চাই না বলে ঘরে দাবি করে বসলাম স্নেহাকে আমি বিয়ে করতে চাই।
বাবা মা যেন আকাশ থেকে পড়লেন আমার কথা শুনে। যে ছেলে কোন মেয়ের দিকে আজ অব্দি মাথা তুলে তাকায়নি পাড়ায় এই ছেলের সমতূল্য কোন ছেলে নেই। আজ সেই ছেলে কিনা ভালোবাসার বুলি আওড়াচ্ছে। বাবার চাকরি সূত্রে এই শহরে আসা। এখান থেকেই পড়াশোনা বেড়ে উঠা। এখানে ভাড়া বাসায় দ্বিতীয় তালায় থাকতাম আমরা।
রুম থেকে জালনা দিয়ে একটা মেয়ের যাওয়া আসা দেখতাম সবসময়। তারপর একদিন রাস্তায় দেখা।
রাস্তার ওই এক পলকের দেখায় এই শেষ বিকেলের মেয়েটা আমার মনের সবটুকু জুড়ে রয়ে যায়।
তখন থেকে নিয়ম করে মেয়েটার আনাগোনা লক্ষ্য করতে লাগলাম।
ভালো লাগার মানুষটাকে কেমন জানি দূর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার মাঝে একরকম শান্তি শান্তি লাগত। আড়ালে চোখে চোখে রাখা। আমাদের দুতলার ঘরের বেলকনি থেকে স্নেহাদের ঘর দেখা যেত। রোজ নিয়ম করে স্নেহাকে দেখার নেশা পেয়ে বসেছিল আমাকে।
স্নেহা তখন ইন্টার পাশ করেছে মাত্র। আমি অনার্স থার্ড ইয়ারে। এক বড় ভাই মহল্লায় জুনিয়রদের উৎসাহ দিতে এসএসসি এইচএসসি পাশ করা সব ছাত্রছাত্রীকে একটা ঘরোয়া অনুষ্টানের আয়োজন করলেন। ওই বড়ভাই ছিলেন ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার উনার সাথে ভালোই সম্পর্ক ছিল আমার। তাই অনুষ্টানের অর্ধেক দায়িত্ব আমার উপর এসে পড়ল। ভাইয়া তো ব্যস্ত মানুষ তারপরেও তার এরকম কাজ আমাদেরকে দারুণ অনুপ্রেরণা দিত।
সেই অনুষ্টানের বদৌলতে স্নেহার সাথে প্রথম বার আলাপ হয়। আমি মুগ্ধ হয়ে ওর সরু সিঁথি করা সরলতার প্রেমে পড়ি। মনে হয় আমাদের এই প্রেম শত শত যুগ পুরনো যা লুকায়িত ছিল এতদিন। লাজুক বালিকা ওড়না হাতে যখন আঙুলে ভাঁজ করছিল নিচ দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল যেন ওই ওর আঙুলের বাঁধনে আমি বাঁধা পড়ে যাচ্ছি।
পড়ালেখায় কোন সাহায্য লাগলে যেন অনায়াসে আমাকে বলতে পারে তার নিশ্চয়তা দিলাম।
এমনকি আমার এডমিশনের নিজের হাতে করা নোটগুলোও দিলাম ওকে।
এভাবেই আমাদের প্রণয় শুরু হয়। অল্প দেখা, চোখে চোখ পড়া, লাজুক হাসি আর গন্তব্য যাত্রায় মাঝখানে খানিক দূরত্ব রেখে পাশাপাশি হাটা। বেশ ভালোই চলছিল কয়েক মাস।
অনার্স থার্ড ইয়ারের ফাইনাল পরিক্ষা দিয়ে যখন বাসায় ঢুকতে যাব তখনই দেখলাম ওদের ঘরে বেশ কজন মানুষের আনাগোনা। দৌড়ে বেলকিনে গিয়ে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগলাম। ওদের দরজার ওপাশে অল্প দেখা যাচ্ছিল স্নেহা শাড়ি পড়ে চেয়ারে বসা।
আমার মাথায় যেন আগুন ধরে গেল। এই বয়সে রক্ত গরম হয়। আমি যেন কেউ একজনে হারানোর ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম। মা ভাত খাওয়ার জন্য ডাকলেও খিদে নেই বলে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম।
ভালো মন্দ কোনকিছু চিন্তা না করেই বাসা থেকে বেড়িয়ে স্নেহাদের দরজায় দাড়ালাম। মেহমানরা বিদায় নিয়েছে। আমাকে দেখে স্নেহার ভাই বেশ খানিকটা অবাক হলেন। আমি সোজাসাপ্টা অন্যকাউকে কোনকিছু না বলে স্নেহাকে বললাম, আমাকে বিয়ে করবে?
এই কথাটা স্নেহা শুনে যতটা না অবাক হয়েছে তার থেকে ওর ঘরের লোক বেশি অবাক হয়েছে। ওর ভাই বললেন আমি নাকি আবেগের জুয়ারে বিলাপ করছি।
আমি শান্ত হয়ে সময় চাইলাম। ওদিকে আমি এসব কান্ড করছি তা আমার ঘরের লোক জানে না।
স্নেহারা পিঠাপিঠি চার বোন৷ ওর ছোটো তিনজন। এক ভাইয়ের উপর সব দায়িত্ব। বাবা নেই। খুব একটা আর্থিক অবস্থা ভালো না ওদের।
সবাই বড় হয়ে যাচ্ছে। উনি সময় দিবেন না। বললেন বাড়ি গিয়ে ঘুমাতে তাহলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমি বাসায় গিয়েও শান্তি পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ ফোনে মেসেজ আসলো ' আমি পারব না তোমার থেকে দূরে সরে যেতে।' সাথে সাথে কল দিলাম ফোন বন্ধ!
সন্ধ্যা পেড়িয়ে রাত যেন একেকটা মুহূর্ত কাটছে না আমার। বিছানায় শুয়েও এপাশ-ওপাশ করছিলাম৷
তখন বুঝলাম বিরহের রাত গুলো কত দীর্ঘ হয়। এই দীর্ঘ বিরহ কাটাতে কবিদের কলমে সৃষ্টি হয় কবিতা।
কিন্তু আমি আমার বিরহ দীর্ঘ করতে চাই না মোটেও না।
কোনকিছু না ভেবে পরদিন সকালে মাথা নত করে বাবা মাকে বিয়ের কথা বলে দিলাম। যে আমি কিনা প্রয়োজনে কটা টাকা চাইতে এখন লজ্জা পাই সেই আমি নিজের বিয়ের কথা ভালোবাসার মানুষটাকে কাছে পাওয়ার কথা অনায়াসে বলে দিলাম!
নেই কোন জড়তা নেই আড়ষ্টতা!
ভালোবাসায় বুঝি এমনই শক্তি থাকে। ভালোবাসা নামক সম্পর্কে বাঁধা আসলে সেই শক্তি বহুগুণ বেড়ে যায়।
বাবা মা প্রথমে বিশ্বাস করতে চাইলেন না। আমি ঠান্ডা মাথায় সব বললাম। মা রেগে গিয়ে বললেন পাগল হয়েছিস লোকে বলবে!
লোকে কি আর বলবে! বিয়ের বয়স হয়েছে ছেলে বিয়ে করেছে। লোকের কাজ লোকদের করতে দাও মা ওদের কথায় তো কিছু আসে যায় না!
আমি মায়ের হাত শক্ত করে ধরে বললাম আমি কখনো তোমাদের অবাধ্য ছিলাম না আজও অবাধ্য হতে চাই না। শপথ করছি কোন অভিযোগ আসবে না।
বাবা অনেকক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থেকে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালেন। মা রান্নাঘরে চলে গেলেন। আমি করব বুঝতে পারছিলাম না।
একটু একটু করে যেন স্নেহাকে দূরে সরে যেতে দেখছিলাম।
বিকেলে বাবার ডাকে নিজের বেলকনি ছেড়ে ড্রয়িং রুমে আসি৷ বাবা একটা শপিং ব্যাগ হাতে দিয়ে বললেন তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আসতে। ভেতরে একটা পানজাবী ছিল।
মাকেও বললেন একটা শাড়ি পরে আসতে। একটু পরেই কাজী চলে আসবে।
মা অবাক হয়ে আছেন। বাবা শান্ত চোখে ইশারা দিলেন।
সেইদিন খুব সাদামাটা ভাবে আমাদের আকদ হয়ে যায়।
এই বয়সে বিয়ে করেছি বলে মা বাবাকে কম কথা শুনতে হয়নি আশেপাশের লোকজন কিংবা আত্মীয়স্বজনদের কাছে। তবে বাবার একটা শর্ত ছিল আমি প্রতিষ্টিত হওয়ার পর বড় করে আমাদের বিয়ের অনুষ্টান করা হবে তখন এর আগে না৷ এর আগে কিছুই না।
আমার বাবা রাশভারি লোক। মা প্রথমে স্নেহাকে ঠিক আপন করে নিতে না চাইলেও কদিন পর ঠিকই স্নেহার সবার একজন হয়ে উঠল।
মা একটু দূরে দূরে থাকতেন কিন্তু বাবার বিকেলের চায়ের আড্ডা চলত স্নেহার সাথে। গল্প, দাবা খেলা পত্রিকা পড়ে শুনানো সব এখন স্নেহার দায়িত্ব।
যখন খুব বৃষ্টি হত স্নেহা নিজ হাতে খিচুড়ি আর গরুর মাংস রান্না করে অন্যরকম আমেজ তৈরি করে নিত বাসায়। এরপর শুরু হত বোনদের সাথে ওর লুডু খেলার পালা!
এরমাঝে ওদের সাথে মাও যোগ দিলেন।
কনা আর কনকের সাথে মাও মেনে নিলেন স্নেহা উনার আরেক মেয়ে। বাবা দূর থেকে দেখে হাসতেন।
মার চোখ যখন বাবার দিকে পড়ত মা চোখ দিয়ে এই সুখের সম্মতি জানাত।
স্নেহা সর্বোচ্চটা দিয়ে পরিবারকে আপন করে নিয়েছে। আমিও বলেছিলাম আমার একবারের কথায় আমার পরিবার মেনে নিয়েছে তাহলে বুঝে নাও তুমি কিভাবে আগলে রাখবে এই সংসার!
সাথে ওর পড়াশোনার খরচটাও মা বাবা দিচ্ছে। আমি কোনরকম নিজেরটা ম্যানেজ করে নিতাম।
বাসায় এসে শুনি মা একটু বকাঝকা করছে স্নেহাকে। কারণ হিসেবে জানলাম স্নেহা টিউশনি করাতে চায়। মা বললেন বাড়ির বউ টিউশনে করবে সেটা মেনে নিবেন না। তখন স্নেহা বললো, সে আগেও টিউশনি করে পড়ালেখা চালিয়ে গেছে। আর এখানে সংসারের সব খরচ সাথে বোনদের পড়াশোনা আমার বিভিন্ন ইন্টারভিউয়ে শহরের বাইরে যাওয়ার খরচ সাথে স্নেহার খরচও সব মিলিয়ে কম নয়!
সে এলাকায় টিউশনি করাবে না কলেজের ওদিকে করাবে কেউ চিনবে না। একটু হলেও তো বাবার উপর থেকে প্রেশার কমবে!
মা আবারও ধমকের সাথে মাথায় হাত দিয়ে বললেন আগে বাবা মা ছিলেন না তাই নিজের খরচ নিজে চালিয়েছো এখন বাবা মা আছেন। তিনজনের টা চালাতে পারলে একজন কি দোষ করল! এটা শুনে
স্নেহা সেদিন মাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্না করেছিল।
আমি চাকরির পড়াশোনায় ব্যস্ত! দিন শেষে যখন ক্লান্তি নিয়ে বাসায় ফিরতাম তখন এক শীতল হাওয়ায় যেন মনটা ভালো হয়ে যেত সব ক্লান্তি মুছে যেত।
বিয়ের এক বছর হল আমাদের। স্নেহাকে কিছুই দেওয়া হয়ে উঠেনি আমার। অনার্স শেষ করে চাকরি সন্ধানি লোক। কিছু টাকা জমিয়ে একজোড়া নুপুর আনলাম ওর জন্য এই প্রথম।
স্নেহা জড়িয়ে ধরে বললো এই পরিবারটাই সবচেয়ে বড় উপহার নাকি ওর জন্য! আর কিছু লাগবে না।
মনটা ভরে উঠল প্রিয় মানুষটাকে আপন করে পেয়ে। আমি আমার ভালোবাসার বৈধতা চেয়েছিলাম বলেই পেয়েছি আজ। আমাদের মোনাজাতের প্রার্থনা এক ছিল বলেই আজ গন্তব্যও এক হয়েছে৷ যারা মন থেকে ভালোবাসার বৈধতা চায় না তারাই মাঝপথে হাত ছেড়ে দেয়।
এভাবে একটু একটু করে ভালোই চলছিল আমাদের।
সমস্যা হয় যখন বাবা চাকরিটা হারান৷ হুট করে বাবা যে কোম্পানিতে চাকরি করতেন সেটা বন্ধ হয়ে যায়।
আস্তে আস্তে কঠিন বাস্তবতার সম্মুখিন হতে থাকি!
এতদিন পর বুঝতে পারি মাথার উপর যে ছায়া ছিল বাবা নামক বটগাছের। সেই গাছটা কতটা রৌদ্রতাপ সহ্য করতে হয়েছে। বাবার পড়ন্ত শরীর এই শরীর নিয়ে আর কিছু করতে মানা করে দিলাম।
কিন্তু দুচোখে অন্ধকার দেখছিলাম। স্নেহা বার বার উঠে দাঁড়ানোর সাহস দিত আমাকে।
কোন আত্মীয়স্বজনের কাছে এতটুকু সাহায্য পাইনি আমি অথচ বাবা ওদের অনেকরকম সাহায্য করেছিলেন একসময়!
সাহায্য না হোক মুখের স্বান্তনাটুকুও পাইনি এতটা অকৃতজ্ঞ হয় মানুষ জানা ছিল না।
বরং উল্টো আমাকে কথা শুনতে হয়েছিল স্টুডেন্ট থাকা অবস্থায় বিয়ে করার জন্য!
আর কারো কাছে হেল্প না চেয়ে নিজেই একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ জোগাড় করলাম বহু কষ্টে!
৮০০০ টাকা বেতন!
এই আট হাজার টাকাও যেন কোটি টাকার মত মনে হয়েছিল। সাথে মায়ের দেওয়া অল্প টাকা দিয়ে ছোট্ট একটা ব্যবসা দাঁড় করানোর চেষ্টা করলাম।
কোনরকম টেনেটুনে সংসার চলছিল ঠিকই।
তখনি স্নেহা বলল সে সেকেন্ড টাইম ভার্সিটি এডমিশনের জন্য প্রস্তুতি নিতে চায়। এভাবে অনেক খরচ! আমি বাঁধা দেইনি। সে নিজের মত প্রিপারেশন নিতে থাকে।
আমি চাকরি আর ছোট্ট ষ্টেশনারির ব্যবসা সামাল দিতে ব্যস্ত। অফিস থেকে ফিরে দোকানে বসি। এর আগে বাবা যতটুকু পারেন বসেন।
অনেক কষ্টের দিনগুলো হয়ত শেষ হতে থাকে। এর মাঝে স্নেহার রাজশাহী ভার্সিটিতে চান্স হয়ে যায়!
এখান থেকে খানিকটা দূরে।
মা প্রথমে রাজি না হলেও অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করিয়ে নিই। কারণ আমার ভালোবাসার মানুষটার উপর পুরো বিশ্বাস আর ভরসা ছিল।
এভাবে স্নেহা চলে গেল ভার্সিটি সপ্তাহে দুদিন এসে থেকে যেত বাসায়। টুকটাক খরচ সে টিউশন করিয়ে ম্যানেজ করে নিত। আমার উপর প্রেশার দিতে চায় না সে। যদিও সেটা শুধু আমি জানতাম মাকে জানানো হয়নি।
সে বার বার বলত এটা তার শ্বশুরবাড়ি মোটেও মনে হয় না নিজের জন্মস্থান মনে হয়।
দিন যেতে যেতে আমিও একটা ভালো জব পেলাম। সময়টা পাল্টাতে লাগল খুব দ্রুত। সময় পাল্টানোর সাথে সাথে খেয়াল করলাম আমার কাছের মানুষগুলোও পাল্টাতে লেগেছে।
স্নেহার ফোন প্রায় বিজি পেতাম। জানতে চাইলে বলত এটা সেটা এক্সামে বন্ধুদের সাথে কথা চলে।
মাসে টাকার পরিমাণ বেড়ে গেল ওর। টিউশনি করাতে আর ওর ভালো লাগে না আমিও কিছু বলিনি।
অনেক ঝড়ঝাপ্টা পেড়িয়েছে মেয়েটা আমার সাথে থাক আর কিছু করতে হবে না।
কিন্তু সময়ে সময়ে সেটা বাড়তে থাকে। ওর অনার্স শেষ হয়। আমি বাচ্চা নিতে চাইলাম। সে নারাজ। বিয়ের এত বছর পর বাবা মায়েরও একটা শখ আছে আর অনার্স শেষ হয়েছে এত আপত্তি কেন তাহলে। অবশেষে সে রাজি হল।
আমাদের ঘর আলো করে আসে নিহান আমাদের ছেলে।
বাবা মা কত খুশি! কিন্তু কেন জানি স্নেহার পাল্টে যাওয়াটা আমার মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল। বাচ্চার প্রতি ওর মনযোগ কম। একজন মা হয়েও তার এমন স্বভাব কেন আমি সেটাই ভেবে পাচ্ছিলাম না।
মাস্টার্সে ভর্তি হয় স্নেহা।
নিহানের বয়স যখন ৫ মাস তখন ওর ভার্সিটিতে মাস্টার্সের কি একটা এক্সাম শুরু হয়। বাসা থেকে দূরে হলেও আমি ওকে আনা নেওয়া করতাম।
নিহান মায়ের কাছে থাকত৷
স্নেহার ইচ্ছা সে ভার্সিটির হলে থাকবে! কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব। সে বাচ্চাকে নিয়ে তো ওখানে উঠতে পারবে না। অনেকটা ঝামেলা হয় এসব নিয়ে। মা সব শুনে বললেন স্নেহার মাস্টার্স শেষ না হওয়া অব্দি কয়েক মাসের জন্য ভার্সিটির আশপাশে কোথাও বাসা নিতে।
কয়েকটা মাসই তো। এরপরে শেষ বাসায় চলে আসবি।
কিন্তু অদ্ভুত ভাবে স্নেহা সেটাও মানতে নারাজ। সে ভার্সিটির হলেই উঠবে আলাদা বাসায় না। আর নিহান নাকি এখানেই থাকবে মানে ওকে ছাড়া।
আমি জোর গলায় বললাম পাগল হয়েছো স্নেহা! ৬ মাসের বাচ্চা তোমাকে ছাড়া ওর চলবে কি করে?
মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার?
সেটা তোমার আগে বুঝা উচিত ছিল। স্নেহা বললো।
আমি তোমার পড়াশোনা মেনে ওখানে বাসা নিতে চাইছি ভার্সিটির কাছে তাতেও এত সমস্যা কেন তোমার?
স্নেহা অদ্ভুত ভঙ্গিতে বললো তার আর এসব ভালো লাগছে না।
আমি আসলেই কিছু বুঝতে পারছিলাম না। ওর এত বদলে যাওয়ার কারণ কি।
ভার্সিটিতে এক্সাম শুরু হল। কাউকে কিছু না বলেই সে হলে উঠল গিয়ে। আমি বার বার অবাক হচ্ছিলাম। ও নিজের থেকে একবারও ফোন দেয় না আমিই দিতাম।
আমি কোথায় ওর কমতি রেখেছি সেটাই খুঁজে পাচ্ছিলাম না৷
এদিকে নিহান অসুস্থ হয়ে পড়ে। ওকে নিয়ে দৌড় শুরু হয় আমার। কি একটা অসুখ দিন দিন যেন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছিল বাচ্চাটা। স্নেহাকে নিহানের কথা জানালে সে বললো এক্সাম শেষ হলে আসবে।
আমি কোন রাস্তা পাচ্ছিলাম না।
বাচ্চাটার অসুস্থতায় সবচেয়ে বেশি মায়েরা কাছে থাকে কিন্তু সেই মা ওর পাশে নেই। কেমন জানি ঘৃণা হচ্ছিল স্নেহার উপর।
ডাক্তার জানালো জন্মের পর থেকে নিহানের হার্টে সমস্যা তবে এখন অজানা কোন একটা কারণে ওর শরীরে রক্ত উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রক্তে ভ্রুণ মেরু সচল না।
দিকদিশা হারিয়ে ফেলেছি আমি। কোথায় যাব কার কাছে যাব! চাকরি ঘর সব ভুলে বাচ্চাটার পেছনে ছুটছি শুধু।
হঠাৎ সকালে ফোন আসলো স্নেহার রুমমেট ফোন দিয়েছে। বললো একবার ভার্সিটির হলে যেতে।
গিয়ে যা শুনলাম তা যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
স্নেহা কোন এক সিনিয়রের সাথে চলে গেছে। ওর মাস্টার্সের পরিক্ষা গত চারদিন আগেই শেষ হয়ে গেছিল৷ যাওয়ার আগে একটা চিঠি রেখে যায় আমার নামে। সবশেষে একটাই কথা ওর খোঁজ যেন না নিই আমি!
পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেছিল আমার। ওর প্রতি তীব্র ভালোবাসা যেন ঘৃণা রুপান্তরিত হল কয়েক সেকেন্ডে!
একটা মেয়ে তার উপর সে মা! মা হয়েও এমন করতে পারল কি করে সে!
পাগলের মত হয়ে গেছিলাম আমি। শুধু নিহানের জন্য কিভাবে নিজেকে ঠিক রেখেছি জানি না।
মা বাবা বাকশূন্য দৃষ্টি আমাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছিল বার বার।
আর আশেপাশের কথা তো বাদই দিলাম।
বাংলাদেশের বাইরে মাদ্রাজে নিয়ে গেলাম নিহানকে চিকাৎসার জন্য ৷
ওই নিহানের মাঝেই যেন আমার প্রাণ ভোমরা রয়ে গেছে। সাত মাসের বাচ্চার যতটা দরকার মায়ের তার সবকিছু বাবা হয়ে করে গেছি আমি! ওই পবিত্র চেহারায় যেন প্রাণ আটকে থাকত আমার।
মাদ্রাজে ডাক্তার দেখিয়ে বেশ রাত হয়ে যায়। ওকে নিয়ে হোটেল রুমে উঠি। আমি কোনরকম খাওয়াদাওয়া শেষ করেই দেখলাম নিহানের শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেছে। বাচ্চাটা আমার ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। বার বার ঝাপটে ধরছে আমার শার্টের বুক পকেটটা।
আমি জোরে জোরে আল্লাহকে ডাকলাম। আমার সন্তাকে যেন ফিরিয়ে দেন উনি।
এ জীবনে তো খুব বেশি চাওয়ার নেই আমার!
ওকে নিয়ে এভাবে ফজরের আজান পড়ে যায়। পাশে রেখেই জায়নামাজ নিয়ে নামাজে দাঁড়ালাম। জীবন ভিক্ষা চাইলাম ছেলেটার।
ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে আমার ছেলেটা।
ওর দিকে তাকিয়ে ভাবলাম,
আমার ভুলটা কোথায় ছিল? নিজের অল্প বয়সের ভালোবাসাকে বৈধতা দিয়েছিলাম বলে। নাকি স্ত্রীর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে ছিলাম বলে আজ স্নেহা আমার সাথে এমন করল! কোথায় ছিল আমার ভুলটা! এই অমীমাংসিত জীবন গাঁথা কেন আমার!
এত এত প্রশ্ন! উত্তর নেই একটাও।
নিহান জানলার দিকে তাকিয়ে আছে। ভোরে সূর্য উঠছে গগণে! নতুন ভোর!
নিহানকে জায়নামাজে বসা অবস্থায় কোলে নিয়ে ঝাপটে ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বললাম,
' এই সূর্য যেন অস্ত না যায়। '
[ সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা ]
ফাবিহা ফেরদৌস
৪/১০/২১
Comments (0)