Search

গল্পঃ ঝগড়াপুর

  • Share this:

আব্বা আম্মার মধ্যে তুমুল ঝগড়া লাগছে। যেকোনো মুহুর্তে মারমারি কাটকাটি অবস্থা। এমন সময় আম্মা এসে বললো, "রিফাত! ফেসবুকে লাইভে যায় কেমন করে? শিখায় দে তো"। আম্মাকে বললাম, "আম্মা আপনি আর আব্বা যেটা মনোযোগ দিয়ে করতেছেন সেইটা করেন না। এরমধ্যে নিস্পাপ ফেসবুক কে টেনে নিয়ে আসেন কেন? আর নিয়ে আসছেন যখন সমস্যা নাই। কিন্তু এই নিরীহ লাইভ অপশনটাকে টানতেছেন কেন?" আম্মা আমার গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় দিয়ে বললো, "হইছ তো একদম বাপের মতো। মানুষ হও বুঝলা। এত প্রশ্ন না করে যেইটা বলছি এইটা করো।" উপায় না পেয়ে আম্মার আইডি থেকে তারে লাইভের ব্যবস্থা করে, নিজের আইডি দিয়ে মায়ের ঝগড়ার লাইভ ভিডিও দেখতে লাগলাম।

আম্মা লাইভে বলতেছে, "হ্যাঁ বন্ধুরা দিন দিন যৌথ পরিবার ভেঙে ক্ষুদ্র পরিবার সৃষ্টি হওয়ার কারণে ঝগড়ার আর আগের পরিবেশ টা নেই। তাই আমি রিফাতের আম্মা আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি ফেসবুক লাইভ ঝগড়া দেখার ব্যবস্থা। আগে ঝগড়া করলে শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, দেবর, ননদসহ আশেপাশের মানুষরা এগিয়ে আসতো। কিন্তু ক্ষুদ্র পরিবার হওয়ার কারণে এখন কেউ এগিয়ে আসেনা। ছেলেপেলে তো সারাদিন মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। তাই আমি এগিয়ে এসেছি ঝগড়ার পুরাতন ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে।"

তারপর লাইভ আব্বার দিকে ফিরিয়ে বললো, "তুমি কি বলতেছিলা আমায় বিয়ে করে তোমার জীবনের সাতাশ বছর নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু তুমি জানো তোমাকে ভালবেসে বিয়ে করে আমার কি কি নষ্ট হইছে!

আব্বা আমার একটা মন্ত্রণালয়ের ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করেছিল। সেই ছেলে এখন ঢাকা শহরে তিনটা বাড়ির মালিক। সেদিন খবর পেলাম। পূর্বাচলে তার ফ্ল্যাট কিনার পরিকল্পনা আছে। ওমা! সাথে সাথেই দেখি পোস্টে নানা কমেন্ট দিছে। "হ্যাঁ মা,তোর এখনো মনে আছে ছেলেটার কথা। তোকে অনেক বুঝিয়েছি। কিন্তু তুই রাজি হলিনা। তুই রাজি হইলে এই অবস্থা তোর হতো না।"

নানার কমেন্টের নিচে দাদা রিপ্লাই দিছে, "আমার ছেলের বিয়েও এক ব্যবসায়ীর একমাত্র মেয়ের সাথে প্রায় পাকা করেছিলাম। সে মেয়ে এখন ঢাকা শহরে পাঁচটা গার্মেন্টসের মালিক। এই মেয়েকে বিয়ে করলে আমার ছেলেও রাজার হালে থাকতো।" ওমা একটু পরে দেখি দাদার কমেন্ট ডিলিট। বুঝলাম আম্মা কমেন্ট ডিলিট দিছে। দাদাও কম যায় না। সাথে সাথেই আবার কমেন্ট দিছে আম্মার লাইভে। বউমা কমেন্ট ডিলিট দেও কেন। মুরুব্বিদের কথার মধ্যে কমেন্ট ডিলিট দেও।নিজের বাপের কমেন্ট তো ঠিক ই রাখছ। এরমধ্যে দেখি আব্বা কথা বলা শুরু করেছে।

"সারাদিন যে বাপ বাপ করো। কি করছে তোমার বাপ তোমার জন্য। বিয়েটা করায়েই শেষ। কিন্তু তোমার বাকি বোনের জামাইদের ব্যবসার জন্য টাকা পর্যন্ত দিছে। আমাকে কি দিছে তিনি!" আম্মা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বললেন, "দেখছেন বন্ধুরা! কত বড় লোভী আমার স্বামী। সে শ্বশুরের সম্পত্তির দিকে তাকায়। বিয়ের সাতাশ বছর পরেও আমাকে সম্পত্তির খোঁটা দিলো।" এরমধ্যে দেখি আম্মার লাইভে হাজার হাজার মানুষ জয়েন করেছে। এক মেয়ে বলছে ঠিক বলছেন আপা।পুরুষ জাতটাই এমন। সারাজীবন এদের জন্য কিছু করলেও নাম নাই। যাইহোক ঝগড়া চালায় যান। আমরা আছি আপনার সাথে।

এবার আম্মার লাইভে কমেন্ট করছে প্রেমিকা। এই মেয়ে আবার ওকালতি নিয়ে পড়াশুনা করে। কথায় কথায় মামলার হুমকি দেয়। সে লিখেছে, "আন্টি আঙ্কেলের নামে যৌতুকের একটা মামলা দিতে পারেন। সাথে নারী নির্যাতন উল্লেখ্য করলে মামলা শক্ত হবে"। প্রেমিকার কমেন্ট দেখে আম্মা বলে উঠলো, "হ্যাঁ বোন। আমি আমার ছেলের সাথে কথা বলে এই বিষয়ে একটা ব্যবস্থা নিচ্ছি। মামলা আমি আজ হলেও দিবো। কাল হলেও দিবো। বিল গিটস যদি এই বয়সে বউ ছাড়তে পারে। তবে আমি রিফাতের মা স্বামী ছাড়তে পারমু না কেন?" এবার আর আম্মার লাইভে কমেন্ট না দিয়ে থাকতে পারলাম না। আমি লিখলাম, ছেলের ভবিষ্যৎ বউকে বোন ডাকছেন কেন আম্মা! আর আম্মা ওটা "বিল গিটস" নয় "বিল গেটস" হবে। আর কথায় কথায় রিফাতের আম্মা বলেন কেন? আপনার তো আরেক ছেলে আছে। তার নাম বলতে পারেন না?

এবার আম্মা লাইভে বললো, "রিফাত দিন দিন তো বাপের পক্ষে কথা বলছ। তোমার নানা মতিঝিলের ফ্ল্যাট আমার নামে দিতে চেয়েছিল। ঠিক আছে। ঐটা তোমার ছোটো ভাই রিয়াদের নামে করে দিবো।" আম্মার কথা শুনে তাড়াতাড়ি কমেন্ট ডিলিট করে দিলাম। আম্মা বললেন, "কমেন্ট ডিলিট করে লাভ নাই রিফাত। তুমি ভালো হয়ে যাও। তোমাকে আমি অনেক সুযোগ দিয়েছি।"

এর মধ্যে আল্লাহর রহমান হয়ে উপস্থিত লোডশেডিং। আম্মার লাইভ বন্ধ। আম্মা দৌড়ে আমার রুমে এলো। রিফাত তোর ফোনে ডাটা নাই। হসপট অন করে দে। আমি ঝগড়ার কথা গুলো গুছিয়ে এনেছি আর এর মধ্যে কারেন্ট চলে গেছে। তাড়াতাড়ি হসপট দে। নাহলে ভিউয়ার কমে যাবে। ঠাসা একটা মিথ্যা কথা বললাম, আমার ফোনে ডাটা নেই। আম্মা রাগে কটমট করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

দুইঘন্টা পরে যখন কারেন্ট এলো। ফেসবুকে ঢুকে দেখি আম্মার লাইভ রীতিমত ভাইরাল। হাজার হাজার লাইক, কমেন্ট শেয়ার। কিন্তু এদিকে আব্বা বাঙ্গি কিনে আনার পর থেকে আব্বা আম্মার মিল হয়ে গেছে। বাঙ্গি আম্মার প্রিয় ফল।আম্মার সাথে আব্বার ঝগড়া লাগলেই আব্বা বাঙ্গি কিনে আনে।আম্মার লাইভের কমেন্ট বক্সে ঢুকে দেখি অনেক মেয়ে বলছে এভাবেই মেয়েদের অধিকার আদায় করে নেওয়া উচিৎ। আর ছেলেরা বলছে, আঙ্কেল টাকে কথা বলার সুযোগ ই দেয়নি আন্টিটা। এইখানে পুরুষদের অধিকার খর্ব করা হয়েছে।

আম্মার রুমে গিয়ে অনেক বুঝিয়ে তার লাইভ টা ডিলিট করালাম। কিন্তু যা হবার তা হয়ে গেছে। মানুষ লাইভ ডাউনলোড করে ইউটিউব আর ফেসবুকে ছড়িয়ে দিয়েছে। আম্মুকে নিয়ে দুষ্ট ছেলেদের পেইজ আর গ্রুপ খোলা শেষ। এক রাতে আম্মুর ফলোয়ার পঁচিশ হাজার। টিকটকার ছোটো ভাই রিয়াদকে ডাক দিয়ে দেখাইয়া বললাম, "দুই বছর টিকটক করে দুই হাজার ফলোয়ার করতে পারিস নাই। আর আম্মার এক লাইভে পঁচিশ হাজার।" দেখি ছোটো ভাইয়ের চোখ ছলছল করে।যেকোনো সময় কেঁদে দিবে।

আম্মার লাইভের পর থেকে ঘরের বাইরে বের হওয়া কঠিন হয়ে গিয়েছি। যেখানেই যাই সবাই বলে, আরেহ! আপনি দেই ঝগড়াইট্টা আন্টির ছেলে না? তার কভার ফটোতে আপনার ছবি দেখছি। অনেক ছেলে সুন্দরী মেয়েরা এসে জোর করে ছবি তুলে নিয়ে যায়। আর একটা সংস্থা আছে, "ঐতিহ্য রক্ষাকারী সংস্থা"। তারা কদিন থেকে ফোনের উপর ফোন। এদের একটাই দাবি। আম্মার ঝগড়ার একটা এইচডি ভিডিও চায়। এরা সেই ভিডিও দিয়ে নাকি ঐতিহ্য রক্ষা করবে।

কাল আম্মাকে অনেক বুঝিয়ে বলেছি।আম্মা ঝগড়া হইলে আর লাইভ করবেন না। মানুষ হাসাহাসি করে। আপনার ছোটো ছেলেও একটা বিশেষ কারণে চোখের পানি ফেলে। এইসব আর কইরেন না আম্মা।

কিন্তু আজ সকালে আব্বা বাজার থেকে পঁচা মাছ আনছে। এটা দেখে আম্মার মেজাজ খারাপ। দুই একটা কথা হওয়ার পরেই দেখি তাদের আবার প্রচন্ড ঝগড়া শুরু।ছোটো ভাইকে ডাক দিয়ে বললাম, হারামজাদা! তাড়াতাড়ি রাউটার বন্ধ করে দিয়ে আয়। আর আম্মাকে কবি সকাল থেকে ওয়াইফাই নাই। আমার চিন্তা সত্যি প্রমাণ করে দিয়ে আম্মা আমার রুমে ছুটে এলো। বললো, তাড়াতাড়ি চেক করে দেখ আমার ফোনে নেট কানেকশন পাচ্ছে না। আমি আমতাআমতা করে বললাম, সকাল থেকে ওয়াইফাই নাই আম্মা। আম্মা ঠাস করে আমার গালে একটা থাপ্পড় দিয়ে বললো, দিন দিন বাপের মতো মিথ্যে কথা শিখতেছ। আমি জানি তুমি এমন কিছু বলবা তাই গতকাল ই আমি ড্রাইভারকে দিয়ে ফোনে ডাটা প্যাকেজ কিনে নিয়েছি। একটু পরে পাশের রুম থেকে শুনতে পেলাম- " হ্যাঁ বন্ধুরা আজকে আবার আমি লাইভে চলে এলাম। "

কানে হেডফোন দিয়ে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে গান শুনছিলাম। ছোট ভাই কখন রুমে এসে পাশে শুয়েছে টের পাইনি। ওর দিকে তাকাতেই আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে বললো, "ভাইয়া একটু আগে চেক করলাম ছত্রিশ হাজার ছুঁইছুঁই করছে আম্মা ফলোয়ার।" ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম, "কাঁদিস না ভাই। তুই এবার টিকটক বাদ দিয়ে ব্লগিং কর। আর একটা কথা মনে রাখিস। পুরুষদের কেউ নাই।"

রিফাত আহমেদ

Tags:

About author
আমি গল্প এবং বই প্রেমিক একজন মানুষ। গল্প এবং বই পড়তে খুবই ভালোবাসি। যেখানেই যে গল্প অথবা কাহিনী খুজে পাই সেগুলো সংগ্রহ করি এবং আপনাদের সাথে শেয়ার করার চেষ্টা করি। আমি নিজেও কয়েকটি গল্প লিখেছি তবে সেগুলোর সংখ্যাটা খুবই সামান্য।