'তোর মা বেশ্যা'
এই শুনে আমার পৃথিবী যখন দুলে উঠলো ঠিক তখন পশ্চিম আকাশে সূর্য বিদায়সম্ভাষণ জানানোর আয়জনে ব্যস্ত।সময় এক অদ্ভুত বস্তু। এই অদ্ভুত বস্তু-কে ধরে ধরে চলুন একটু পিছনে ঘুরে আসার চেষ্টা করি।
আমি তখন স্কুল পড়ুয়া এক টগবগে কিশোর । কিছুদিন পরই পরীক্ষার বিপদ সংকেত। আমার বাসা ঢাকার অদূরে দক্ষিণখান এলাকার এক ছ-তলা বাড়িতে। আমরা দুই ভাই-বোন।আমি এবং রিতু। রিতু ক্লাস থ্রি তে পড়ে আর আমি ক্লাস নাইনে। বাবা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে স্বল্প বেতনে চাকরি করে।স্বল্প বেতন হলেও একটি স্বাভাবিক মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য যা যথেষ্ট। সাধারণত একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের যে টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় -তেমন কিছুই আমাদের পরিবারে ছিলো না। আমার বাবা খুবই স্বাধীনচেতা মানুষ। বাবা বলে, স্বাধীনচেতা ই যদি হতে না পারি দেশ স্বাধীন করেছি কেনো? 'স্বাধীনতা এবং স্বাধীনচেতা' এ দুটি শব্দ যে এক নয় মা বোধকরি হাজারবারের ও বেশি বাবা কে বুঝানোর চেষ্টা করেছে।বাবা বুঝেনি।প্রায়ই , অফিস থেকে এসে বলতো, এই তোরা ব্যাগ গুছিয়ে নে।আজ রাতে সিলেট যাচ্ছি। কখনো বলতো সাজেক কিংবা কখনো সেন্ট মার্টিন।মা প্রতিবারই বলে 'না আমি যাবো না।সংসারের কোনো খেয়াল আছে তোমার?'
বাবা বলতো, 'প্রকৃতিই আমার সংসার'
বাবা-মায়ের সাংসারিক ঝগড়ার চেয়ে রোমান্টিসিজম ই আমাদের চোখে বেশি পড়েছে। মাঝরাতে টয়লেট যাওয়ার জন্য উঠে প্রায়ই দেখা যেতো বাবা-মা ড্রইং রুমে বসে রোমান্টিক মুভি দেখছে।মা রাগ করলে বাবা হরেক রকমের আয়োজন করে সে রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করেছে।কখনো বা আমাদের হাতে প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে।যাতে থাকতো জীবনানন্দ, মহাদেব সাহা কিংবা রবীন্দ্রনাথের কবিতা-যা বুঝার বয়স তখন আমাদের ছিলো না। একবার বাবা অফিসের কাজে চট্টগ্রাম গিয়ে এক সপ্তাহের বেশি সময় থাকতে হয়েছে।ফিরে এসে দেখে মা গোমড়ামুখে বসে আছে; কথা বলছে না। সেদিন আমাদের হাতে প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে ছিলো,
'তোমারে দেখেছি কবে- সেই কবে -কোন বৃহস্পতিবার
আর এক কোটি বছর হয় তোমাকে দেখি না'
আশ্চর্যজনক ভাবে বাবা বৃহস্পতিবার রাতেই চট্টগ্রাম গিয়েছিল এবং বৃহস্পতিবার রাতেই ফিরে এসেছিলো।সে যাইহোক, সন্তান হয়ে বাবা-মার রোমান্টিসিজমের বর্ণনা করা ঠিক নয় তবুও গল্পের খাতিরে করতে হয়।
এভাবে চলতে থাকে।চলতে চলতে শৈশব থেকে কৈশোরে পদার্পন করলাম।আমাদের শৈশব ছিলো স্বপ্নের চেয়েও উজ্জ্বল। বাবা আমাদের শৈশব-কে এক কথায় সোনায় বেধে রেখেছিলো। যখন যা আবদার করেছি - বাবা হাসিমুখে তা পূরণ করেছে।রিতুর হাসিমুখ দেখে বাবা প্রায়ই বলতো,
' এ জীবনে বোধহয় আমার আর কিছুই পাওয়ার নেই'।
সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিলো।কিন্তু হঠাৎ! কোত্থেকে হঠাৎ কালবৈশাখী ঝড়ের মতো হাজির হলো 'করোনা'। মহামারি! চারিদিকে মানুষের হাহাকার। সরকার ঘোষণা দিলো- লকডাউন।কিছু হলো না -শুরু হলো বিরহকাতর যন্ত্রণা। বাবার চাকরি চলে গেলো পরের মাসেই।সামান্য কিছু টাকা বাবার সঞ্চয়ে ছিলো। তা দিয়ে বড়জোর একমাস চললো। দু-মাসের মধ্যে বাবার মাঝে এক অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা গেলো ।হাসিখুশি চঞ্চল কিংবা স্বাধীনচেতা এ মানুষটি হঠাৎ করে যেন ফেটে পড়া বেলুনের মতো চুপসে গেলো। গম্ভীর হয়ে দিনরাত চিন্তায় মগ্ন হয়ে থাকতো। গভীর সুখে ডুবে থাকা পরিবারটি যেনো এ এক মাসে গভীর শোকের সমুদ্রে ডুবে গেলো। চোখের জল মিশিয়ে কতো রাত মা ভাত খেয়েছে তা বুঝি আমাদের চোখ এড়ায়নি। শুরু হলো, ঋণ।সমানুপাতিক হারে বাড়তে থাকলো দিন দিন। ছ-মাস পর একদিন বাবা কোত্থেকে যেনো এসে বললো,
'ব্যাগ গুছিয়ে নে'
রিতু উৎসুক মুখে বললো,
'কোথায় যাবো বাবা?সাজেক নাকি সেন্ট মার্টিন?'
বাবা বললো, 'যমের বাড়ি'
এই ক্ষুদ্র জীবনে যা দেখিনি সেদিন তাই দেখতে হলো।কি জানি -কেনো সেদিন হতে যাই দেখেছি তাও এ ক্ষুদ্র জীবনে কখনো দেখতে হয়নি কিংবা দেখতে হবে কখনো সে দুঃস্বপ্ন ও দেখিনি।
বাবা রিতু কে ভীষণ মারলো-সাথে আমাকেও।পিক-আপে উঠতে থাকলো এক এক করে সব আসবাবপত্র কিংবা ফার্নিচার। সব নিয়ে সাথে আমাদের নিয়ে -পিক-আপ যখন স্টার্ট দিয়েছে ঠিক তখন ফেসবুক স্ক্রল করতে একটি পোস্ট চোখে পড়লো যাতে লেখা-
এ শহর মধ্যবিত্তদের জন্য নয়
শুরু হলো নতুন অধ্যায়। যে অধ্যায়ের সাথে আমাদের পরিচয় নেই। গ্রামে প্রথম কয়েকদিন বেশ ভালো কাটলো। চাচা-চাচী চাচাতো ভাই-বোন -সবাই মিলে বেশ হৈ-হুল্লোড় হলো। চাচাতো ভাই-বোনদের সাথে আমাদের খুব ভাব হলো। শহর থেকে এসেছি সে সুবাদে আমাদের বেশ আপ্যায়ন ও হলো।দিন গড়ালো।মাস গড়ালো। বাবার কোনো চাকরির খোঁজ নেই। চাচাদের সংসারে ধীরে ধীরে মা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে শুরু করলো তাও আমাদের চোখ এড়ায়নি। দু-মাস যখন পেড়িয়ে গেলো -বুঝতে যখন পেরেছি - আনন্দের দিনক্ষণ আবারো শেষ -তখন পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেছি ব্যবহারের তারতম্য। আকাশ থেকে হঠাৎ তা যেনো মাটিতে নেমে এলো। আমাদের ব্যবহৃত কাপড়গুলো পুরনো হতে থাকলো।মায়ের কাছে আবদার করলে মা শুধু আড়ালে চোখ মুছতো। বাবার মেজাজ প্রচন্ড রুক্ষ হতে থাকলো।পাওনাদারদের কলের যন্ত্রণায় আমাদের উপর মারধর করা শুরু করলো।আমরা বুঝতে পারছিলাম না আমাদের সাথে কেন এমন করতো? শুধু আমরা-তা নয়।প্রায়সময় বাবা মা-কেও মারধর করতো।কিছু নোংরা আর খারাপ শব্দগুচ্ছ আমাদের কানে এসে পৌছাতো। সাথে মায়ের কান্না।
রিতু প্রায়ই মার খেয়ে কেঁদে কেঁদে জিজ্ঞেস করতো,
'ভাইয়া,বাবা এমন হয়ে গেলো কেনো?'
আমি উদাস হয়ে শুনে যেতাম।উত্তর দেওয়া হতো না।
অতঃপর একদিন ঋণের দায় এড়াতে বাবা বাড়ির আমাদের ভাগের অংশটুকু চাচার কাছে বিক্রি করে দিলো।নিজের বলতে আমাদের আর কিছু রইলো না।গল্পের এ অধ্যায়ে, বাবার মাঝে আরেক দফা পরিবর্তন দেখতে পেলাম। যে বাবা একসময় বলেছিলো, 'প্রকৃতিই আমার সংসার'। সে মানুষটি আবারো ফিরে গেলো প্রকৃতির কাছে।দিন-দুপুরে বন জঙ্গলে হেটে বেড়াতে থাকলো।শীতের গভীর রাতে উঠোনের মাঝে শুয়ে চাঁদের দিকে উদাসভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকতো। দিনে দিনে - বাবা কে পাগল বলে সম্বোধন করা শুরু হলো। চাচীদের অপমানে মায়ের শাড়ির আচল ভিজে দিনে কয়েকবার শুকিয়েও যেতো। আমাদের কপালে ভাত আর ডাল ছাড়া কিছু জুটতো না।মাঝেমাঝে আলুভর্তা কিংবা শুধু আলু জুটতো।'মুরগির মাংস ছাড়া ভাত খেতে পারি না'- এই অভ্যাস রাতারাতি বদলে যেতে হলো। রিতুর দিকে তাকিয়ে আমার ভীষণ মায়া হতো। চাচাতো ভাই-বোনরা আর ওর সাথে খেলতো না।আমাদের সাথে কথা বলতো না। রিতু অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাতো। সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজের জন্য নয় ; শিউলি ফুলের মতো সুন্দর এই মেয়েটির জন্য অভিযোগ জানাতে হতো! হে খোদা- এ অভিশপ্ত জীবন থেকে অন্তত এই মেয়েটিকে হলেও মুক্তি দাও! মুক্তি! মুক্তির আশায় ভেতরটা দাবানলের মতো দাও দাও করে জ্বলতে থাকতো!প্রায়ই স্বপ্নে নজরুল এসে বলতো,
হে দরিদ্র তুমি মোরে করেছো মহান!
সেদিন ভরদুপুরে আমি আর রিতু বাড়ির অদূরেই একটি বাগানে বড়ই পাড়ছিলাম।পেড়ে পেড়ে বেশ যত্নে লবণ -মরিচ মেখে মুখে দিলাম। হঠাৎ, মাসুদ এসে বললো,
'তাড়াতাড়ি বাড়িতে আয়। তোদের বাবা মারা গেছে। '
বাবা সত্যিই মারা গিয়েছিলো। রিতু আমাকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো কান্না করছিলো।রাজ্যের মানুষ এসে আমাদের মাথায় হাতে কপালে হাত বুলিয়ে দিয়ে সান্তনার বাণী শুনালো। যে মানুষ গুলো বাজারে হাটে দোকানে বাবা কে পাগল বলে সম্বোধন করতো সে মানুষগুলো এসে বললো,
'আহারে মানুষটা খুব ভালো আছিলো'
বাবার মৃত্যুর পর মা পুরোপুরি দিশেহারা হয়ে গেলো। চাচাদের বাড়িতে মা হয়ে থাকলো কাজের লোক হয়ে।আমাদের ঘরটি ছিলো মূল বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন।একটি টিনের ঘর।দুটি রুম। আমাদের পড়ালেখার খরচ এতোদিন বাবা কোত্থেকে যেনো যোগাড় করে দিতো। অনলাইন ক্লাসের নামে এতো এতো টাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো ছিনিয়ে নিতো। বাবার মৃত্যুর পর আমাদের পড়ালেখা প্রায় বন্ধ হয়ে যাবার উপায় হলো। মা-র কাছে একদিন জিজ্ঞেস করলাম,
'মা,আমরা কি আর পড়বো না?'
মা মুচকি হেসে বললো,
'কেনো পড়বি না?অবশ্যই পড়বি!'
সারাদিন মা কাজ করতো।ওরা মায়ের উপর অমানবিক নির্যাতন শুরু করলো।একদিন - মায়ের কপালে কাটা দাগ দেখে আমি ভীষণ অবাক হলাম। জিজ্ঞেস করলাম-
'মা কপালে কি হয়েছে তোমার? কেটেছে কিভাবে?'
মা বললো,
'রসুন কাটতে গিয়ে কেটে গেছে '
রসুন কাটতে কিভাবে কপাল কাটে আমি তা জানার প্রয়োজন বোধ করলাম না। পরদিন শুনলাম, চাচী মায়ের কপালে প্লেট ছুড়ে মেরেছিল । এভাবেই চলে; চলতে থাকে বিষাক্ত দিনগুলো।
রিতু ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেছে কেনো জানি। যে মেয়েটি সারাদিন কথা বলা থামাতে পারতো না - চাঞ্চল্যের স্রোতে যে মেয়েটি নাওয়া খাওয়া ভুলে যেতো সে মেয়েটির চোখেমুখে আজ গম্ভীরতা। আশ্চর্য!মা প্রায়ই বলে-
'রিতু-তুই আগের মতো কথা বলিস না কেনো?'
রিতু বলে,
'কথা বলতে ভালো লাগে না মা'
মা রিতুকে কাছে টেনে বলে-
'কি করতে ভালো লাগে বল?কতো শুকিয়ে গেছিস।চেহারাও শুকিয়ে গেছে।হাসান,কাল রিতুর জন্য সুন্দর দেখে একটা জামা কিনে আনবি।আমি টাকা দেবো।ওকে সাথে নিয়ে যাবি কিন্তু।'
রিতু মা-কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে।মা রিতুকে আদর করে বলে-
'দেখ দেখ-আমার পাগলি মেয়ে কি করে'
কথাটি বলতে বলতে কখন যে মায়ের চোখেও জল এসে ভিড়েছে কে জানে!
আমি স্বপ্ন দেখি , বড় হয়ে একদিন মা আর রিতু কে আবার সেই পুরনো শহরে ফিরিয়ে নিয়ে যাবো। রিতু আবারো স্কুল যাবে।স্কুল থেকে ফিরে টিভির সামনে বসে নানান সব কার্টুন দেখে কুটকুটে হয়ে হাসবে। মা রিতু-কে গভীর যত্নে খাইয়ে দিবে।ইদানিং রিতু নিজের হাতে খাওয়া শিখে গেছে। খেয়ে আমাকে বলে,
'ভাইয়া,চা খাবি?'
'কোথায় পাবো চা?'
'আমি বানাবো'
আমি হেসে বললাম,
'তুই চা বানাতে পারিস?'
'পারি।মা শিখিয়েছে।তুই বস আমি চা বানিয়ে আনছি'
রিতু চা বানাতে গেলো।কিছুক্ষণ পর মন খারাপ করে ফিরে এলো।কাঁদো কন্ঠে বললো,
'ভাইয়া,চা পাতা নেই'
একটু চুপ থেকে আবার বললো,
'দুধ ও নেই'
আমি মুচকি হেসে বললাম,
'রিতু,আমরা আবার ঢাকায় ফিরে যাবো। আগের বাসায়। তোকে চা পাতা, দুধ আর চিনি কিনে দিবো।তুই চা বানাবি।শুন, চিনি একটু বেশি দিবি।ঠিকাছে?'
রিতু আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। আমার দেখতে ভালো লাগে। রিতুর হাসিভরা মুখে তাকিয়ে জাগতিক সব জটিলতা ভুলতে চেষ্টা করি। হোক না সে হাসি মিথ্যে আশ্বাসে গড়া।তবুও তো হাসি! আচ্ছা,রিতুর হাসি এতো সুন্দর কেনো?
সেদিন রাতে ঝুম বৃষ্টি। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দে আমি আর রিতু মায়ের সাথে খাটের উপর বসে গল্প করছি। মা জিজ্ঞেস করলো,
'খিচুড়ি খাবি? '
আমরা বেশ খুশি হয়ে বললাম,
'হ্যাঁ, মা খাবো'
মা খিচুড়ি বসিয়ে দিলো।খিচুড়ি হতে হতে আমরা ফিরে গেলাম সেই দক্ষিণখানের বাড়ির চারতলায়। সে-রাতে ও খুব বৃষ্টি। বাবা আধ-ভেজা হয়ে অফিস থেকে ফিরেই মা কে বললো,
'খুব বৃষ্টি হচ্ছে।খিচুড়ি বসিয়ে দাও।'
মা খিচুড়ি বসিয়ে দিলো। তারপর আমরা সবাই মিলে মুভি দেখতে বসলাম।মুভিটার নাম আমার স্পষ্ট মনে আছে- হুমায়ূন আহমেদের "আমার আছে জল" । মুভি শেষ হলে আমরা চলে গেলাম বাড়ির ছাদে।বেশ খানিকক্ষণ ভিজে-বৃষ্টিতে হৈ-হুল্লোড় করে বাসায় ফিরে আয়েশ করে খিচুড়ি খেলাম। অতঃপর কাঁথামুড়ি দিয়ে গভীর ঘুম।
আজকের এ অন্ধকার রাতেও বৃষ্টি-চুলোয় খিচুড়ি। অথচ সময়! সময় আমাদের কোথায় নিয়ে এলো -কেনো নিয়ে এলো আমরা জানি না। কারণ খুজে মায়ের চোখের কোণে আবারো জল এসে জমে গেলো।আমি আর রিতু মায়ের চোখের জল খুব যত্নে মুছে দিলাম।কিন্তু থামানো হলো কোথায়?মা আমাদের জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো কাদতে শুরু করলো।আমার বুক তখন গ্রীষ্মের রোদে ফেটে যাওয়া মাটির মতো-উত্তপ্ত লাভার মতো জ্বলছে তো জ্বলছে! কেনো জ্বলছে? কেনো? কতো? আর কতো?
বেশ কিছুদিন পর -একদিন -আমি আর রিতু উঠোনে বসে কাঁচা আম খাচ্ছিলাম।রিতুর কাঁচা আম বেশ পছন্দ।নুন-মরিচ দিয়ে কাঁচা আম। হঠাৎ বড় চাচী কোত্থেকে এসে চিৎকার চেচামেচি শুরু করলো।তার অভিযোগ এই যে, আমরা তার গাছের সব আম চুরি করে খেয়ে ফেলছি।অতঃপর, আমাদের দুজনকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি দিতে শুরু করলো।এক পর্যায়ে বললো,
'বেশ্যার ছেলেমেয়েদের এ বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে হয়েছে যতো বিপদ'
আমার প্রচন্ড খারাপ লাগতে শুরু করলো। ক্ষীপ্ত সুরে বললাম,
'কাকে বেশ্যা বললেন আপনি?'
মহিলা বজ্রকঠিন কন্ঠে বললো,
'তোদের মা কে।তোদের মা বেশ্যা।তোর মা বেশ্যা '
কথাটি মহিলা বারবার বললো নাকি বারেবার প্রতিফলিত হয়ে আমার কানে এসে পৌছালো বুঝতে পারছিলাম না।আমার শরীর থরথর করে কাপতে থাকলো। কিছু বলতে চাইলেও বলতে পারছিলাম না। চাচী যাওয়ার পর রিতু জিজ্ঞেস করলো,
'ভাইয়া,বেশ্যা কি?'
আমি মুচকি হেসে বললাম,
'যারা অনেক কাজ করে মায়ের মতো তাদের বেশ্যা বলে '
রিতু বুঝতে পারে না 'বেশ্যা'র মানে যদি তাই হয়ে থাকে তবে জেঠিমা এমন ভঙ্গিতে কেনো বলেছে?
দিনে দিনে চারদিক থেকে ঠিক এই শব্দটি বারবার শুনতে শুরু করলাম।ঠিক শব্দ নয়।গালি-বেশ্যার বাচ্চা।পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌছালো- কখনো কখনো বৃষ্টিতে দুই ভাই-বোন ভিজতে গেলেও শুনি-
" ওই দ্যাখ বেশ্যার বাচ্চাগুলো কি করছে"
অসহনীয় যন্ত্রণায় জীবন কোথায় গিয়ে পৌছালো তা ভাবতে চেষ্টা করি।চেষ্টা করতেই মার্ক টোয়েন কে মনে পড়ে!
-The lack of money is the root of all evil
সব কিছু ঝাপিয়ে একদিন - জীবনের অনেকগুলো অভিশপ্ত দিনকে যদি তালিকাভুক্ত করি-এই দিনটি নিঃসন্দেহে সবার উপরেই স্থান নিয়ে নিবে। সন্ধ্যার খানিক পর মা মাটির চুলোর পাশে বসে ছিলো।আমি মায়ের পাশে এসে বসলাম। যা বলতে হতো এতোকাল ; যা বলার অপেক্ষায় এতোকাল তাই বলতে হলো,
'আচ্ছা মা, প্রতিদিন মাঝরাতে পিছনের দরজা খুলে কে আসে?'
মা হকচকিয়ে উঠে। বলে,
'কে মানে! কি বলছিস এসব। মা-মাঝরাতে আবার কে আসবে?'
'মা'
'কি?'
'আমি সব জানি মা'
'মানে!কি-কি জানিস তুই?'
'মা তোমাকে দেখে আমার বমি পাচ্ছে"
'কি বলছিস এসব?'
'সন্তান হয়ে মা কে দেখে বমি পাওয়া টা নিশ্চয়ই মহাপাপ। তবুও আমার পাচ্ছে।কি করবো বলো তো?'
মা জবাব দেয় না।চোখ বেয়ে টপটপ করে জল বের হতে থাকে।
'যেখানেই যায়-লোকে বেশ্যার ছেলে বলে গালাগাল দেয়।আমি কোথায় যাবো মা?'
অতঃপর নীরবতা।চারদিকটা গুমোট ধরে আছে।নীরবতা ভেঙে মা চোখ মুছে। বলে-
'আমাকে দেখে তোর বমি পাচ্ছে শুনে ভালো লাগলো।হাসান,আমার কপালের দিকে তাকিয়ে দেখ একবার।'
কপালে সেই কাটা দাগ; গভীর ক্ষত।
'দেখলি?'
দু-হাত মেলে বললো-
'দেখ দেখ তোর মায়ের হাত দেখ। মানুষের হাতের মতো মনে হচ্ছে, হাসান? '
নিশ্চুপ নীরবতা!মায়ের হাতগুলো যেনো মরিচাধরা কোনো লোহার মতো মনে হলো।কিছু বলিনি ; বলার ভাষা খুজে পাচ্ছিলাম না। পৃথিবীতে এতো এতো ভাষা থাকতে আমি ভাষা কেনো খুজে পাচ্ছি না?জানি না!
' কথা বলছিস না যে? যখন তোদের জন্য পশুর মতো খেটে নিজের সব বিলিয়ে দিয়েছিলাম তখন তোর বমি আসেনি?'
তোরা পড়ালেখা করছিস ; গণ্ডায় গন্ডায় টাকা তোদের প্রতিষ্ঠানে গেলাতে হচ্ছে ; দু-বেলা খেয়ে দেয়ে দিনশেষে গভীর ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছিস। তখন একবার তোর মায়ের কথা ভেবে বমি আসেনি? আসেনি রে বাবা আসেনি। আজ আসছে।আজ তোর নিজের মায়ের সামনে কথা বলতেও তোর ঘৃণা হচ্ছে। হবে না কেনো? তোর মা যে -পতিতা ; তোর মা বেশ্যা। বমি কর বাবা। আমার সামনেই কর।ছোটবেলায় তোর যখন ফুড পয়সন হতো ; সারারাত ধরে বমি হতো তোর।খুব কষ্ট হতো ; ঘুমোতে পারতাম না।বিশ্বাস কর আজ কষ্ট হবে না।আজ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবো। বহুদিন এই স্বস্তির দেখা পাই না।আজ একটু স্বস্তির মুখ দেখা আমায়! '
মা-পাগলের মতো কান্না করছিলো।আমি কখনো এভাবে মা-কে কাঁদতে দেখিনি।আমার ভেতরটা জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছিলো।আমি -আমি বুঝতে পারিনি-বুঝা হয়ে উঠেনি -আমি কি করবো! ইচ্ছা করছিলো -মা-কে জড়িয়ে ধরে আমিও একটু চিৎকার করে কাঁদি।বহুদিনের কান্না -জল চোখের কোণে এসে ঘুরপাক খাচ্ছিলো।কিন্তু বের হলো না। জোসনার আলোয় সেদিন এই পাকের ঘর আলোকিত হয়ে উঠেছিলো।আকাশে অসংখ্য তারা খেলা করছিলো।তাদের মধ্যে একটি তারা হঠাৎ করে নিভে গেলো।আমি আকাশের পানে উদাসভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলাম।তারা-টি আর খুজে পেলাম না।
সেদিন রাতে যখন সিলিং ফ্যানের সাথে মা'র লাশ ঝুলছিলো ঠিক তখন জীবনানন্দ আমার কানের কিনারায় এসে বারবার বলতে থাকলো-
শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে ফাল্গুনের রাতের আধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাদ
মরিবার হল তার সাধ
মা মারা গেলো।মাথার উপর সু-বিশাল মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি এসে বললো-'ভেঙে পড়বো?' রিতুর দিকে তাকাতে আমার ভয় হচ্ছিল। সে মূহুর্তে রিতুর দিকে তাকালে আমার এই ধূলোর পৃথিবীতে থাকার বাসনা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে ; আমি জানি! আমি জানি না শুধু আমাদের পরিণতি। এই শিউলি ফুলের মতো সুন্দর মেয়েটির পরিণতি! সৌরজগতের এই বিষাদগ্রস্ত গ্রহে ৭৫০ কোটি মানবসন্তান। অথচ-আমাদের কেউ নেই। বারবার ভেবে দেখি-কেউই কি নেই? নিজের কাছেই বারবার প্রতিফলিত হয়ে শব্দগুলো শুনি- তোদের কেউ নেই!
বেশ্যার মৃত্যু! আর দশটা বেশ্যার মৃত্যুতে যা হয় ঠিক তাই হলো। গল্প-উপন্যাস হোক কিংবা বাস্তব! পতিতাদের জানাজা হয় না।মায়ের লাশ নিয়ে যখন মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে গেলাম -ভদ্রলোক বললো-
'বাপজান, তোমার মায়ের জানাজা হইবো না'
আমি বললাম-
'কেনো হবে না?'
ইমাম সাহেব জবাব দেয় না।পাশের একজন আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে বলে-
'বেশ্যাদের জানাজা হয় না'
জানাজা ছাড়ায় মায়ের লাশ দাফন হলো বাবার কবরের ঠিক পাশেই।বাবার কবরের উপর কে যেনো কয়েকটি সুন্দর ফুলের চারা রোপণ করে দিয়েছিল।সেগুলো বড় হয়ে কবরের উপর সোজা হয়ে দাড়িয়ে আছে। কি যে সুন্দর লাগছে!বাবা-মা পাশাপাশি শুয়ে আছে। মনে পড়ছে -বাবা -এক সপ্তাহ পর চট্টগ্রাম থেকে যেদিন ফিরে এসেছিলো সেদিনের কথা।এক কোটি বছর পর- কে জানে পাগল-বাবা হয়তো আজও মাকে পাশে পেয়ে বলছে-
- তোমাকে দেখেছি কবে, সেই কবে, কোন বৃহস্পতিবার
আর এক কোটি বছর হয় তোমাকে দেখি না
কি আশ্চর্য! বাবার মৃত্যু ও যে রোজ বৃহস্পতিবারেই হয়েছিলো।
হিহিহিহি!
পরিশিষ্ট ঃ
মায়ের মৃত্যুর দু-মাস পর- অত্যাচার সইতে না পেরে আমি আর রিতু পালালাম। আমাদের বাসস্থানের ব্যবস্থা হলো। কমলাপুর রেলস্টেশন। আমরা দুই ভাই-বোন গুটিসুটি মেরে শুয়ে বসে রাত কাটিয়ে দেই।দিন হলে - দু-জন কাধে দুটো বস্তা নিয়ে বের হয়ে পড়ি।যে পথ ধরে আমরা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে স্কুলে যেতাম সে পথ ধরে আজও আমরা হাটি।তফাত হলো -আজ আর কাঁধে স্কুল ব্যাগ নেই -পড়নে সেই সাদা-নেভি ব্লু স্কুল ড্রেস নেই।আছে শুধু পড়নে ছেড়া কাপড় আর কাঁধে পুরনো পাটের বস্তা।
শহরের অলি-গলির ডাস্টবিনে থাকা পুরনো বোতল কিংবা উচ্ছিষ্ট খুঁজি।খুঁজে দু-বেলা অন্ন জুটে যায় । লোকে আমাদের নতুন নাম দিয়েছে। কেউ বলে -পথশিশু। কেউ বা বলে -টোকাই। আমার দুটো নামই পছন্দ।রিতুকে জিজ্ঞেস করি,
'তোর কোন নামটি পছন্দ?'
রিতু বলে,
' পথশিশু অনেক সুন্দর নাম।আচ্ছা ভাইয়া,পথশিশু মানে কি?'
'পথশিশু মানে পথের শিশু'
রিতু উৎসুক কন্ঠে বলে-
'ভাইয়া আমরা যখন বাসায় ছিলাম তখন কি আমাদের বাসার শিশু বলা হতো?'
আমি হাসি।রিতু কে দেখে আমার ভীষণ মায়া হয়।মায়ার ঘোরে স্বপ্ন দেখি -একদিন আবারো রিতু সুন্দর পৃথিবীতে বিচরণ করবে। স্বপ্ন শেষ হয় ; দিন ও শেষ হয়।দিনশেষে শহর নিশ্চুপ হয়ে যায় ; পৃথিবীর আকাশে বিশাল চাঁদ উঁকি দেয়; আমরা দু-জন খোলা আকাশের নিচে শুয়ে থাকি ; আকাশ দেখি ; চাঁদ দেখি ; নক্ষত্রের আয়োজন দেখি। রিতু চাঁদের দিকে আঙুল তুলে।মৃদু কন্ঠে বলে-
'ভাইয়া,চাঁদটি দেখতে ঠিক রুটির মতো। তাই না?'
আমি মুচকি হাসি। বলি,
"পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি"
লেখাঃ মাহমুদ ফানতাসির
Comments (0)