মকবুল সাহেব চিন্তিত মুখে স্ত্রী নিলুফা বেগমের সাথে নিচু স্বরে কি যেন বলাবলি করছেন। মিরুর চোখ এড়ায় না। মা'কে জিজ্ঞেস করতেই আমতাআমতা করে তিনি বলেন- পরদিন সকালে মকবুল সাহেবের একটা প্রোগ্রামে যেতে হবে। কিন্তু কাপড় আয়রন করা নেই। এদিকে রাত বেশি হওয়ায় লন্ড্রির দোকান ও বন্ধ। মিরু বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করে - তো? এতো চিন্তার কি হলো বুঝলাম নাতো।আমি পারবো না? নাকি আমার আনাড়ি হাতের কাজ বাবার পছন্দ হবে না।বলেই ছোঁ মেরে হাতের কাপড়গুলো নিয়ে মিরু বসে যায় আয়রন করতে। মকবুল সাহেব আর নিলুফা বেগম দুজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন।মা মিনমিন করে একবার শুধু বলার চেষ্টা করলেন - ও সোনা,থাক তোমার কষ্ট হবে...।মিরুর কপাল কুঁচকানো চাহনিতে আর বাকিটা শেষ করলেন না।
সুন্দরী, উচ্চ শিক্ষিতা এবং তুলনামূলক অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়েকে বউ করে এনে প্রথম দিকে শাহেদের পরিবার মিরুকে কিছুটা সমীহ ও দূরত্ব বজায় রেখে চলতো।ভিন্ন পরিবেশের মেয়ে। কেমন না কেমন হয়। এ নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন তারা।মিরু খুব ভালোই বুঝতো সেটা। তাই বিয়ের পর তার প্রথম দায়িত্ব হয়ে পড়ে তাদেরকে সহজ করে নেওয়া।খুব অল্প দিনে সে সফল ও হলো।তার অকৃত্রিম আচরন এবং বাচালতা দিয়ে।মিরু অনবরত কথা বলতো।বাবা মায়ের গল্পের খেই ধরিয়ে দিতো। বৃদ্ধ বয়সে মানুষ খুব করে চায়, কেউ তার কথা মন দিয়ে শুনুক, তাকে গুরুত্ব দিক। ওনারা গল্প বলা শুরু করলে মিরু মনোযোগী শ্রোতা হয়ে যেতো।মজার গল্পে টিপ্পনী কাটতো।মা যেদিন খেয়াল করলেন মিরু নিজে গরুর ভুঁড়ি খায়না অথচ ছোট দেবরকে হাতে মাখিয়ে খাইয়ে দিতে,সেদিন বলেছিলেন- খা, ভাবির হাতে খেয়ে নে।মায়ের হাতে খাওয়া তো কখনো কপালে জোটেনি। এতগুলো ছেলেপেলে, কাকে রেখে কাকে মুখে তুলে খাওয়াই!
মকবুল সাহেব মিরুর হাত খালি দেখে বললেন - মা, নতুন বউয়ের হাত খালি রাখতে নেই।অমঙ্গল হয়।বাবা গ্রামের মানুষ। পুরোনো ধ্যানধারনা তার।মিরুর তো চুড়ি পরার অভ্যাস নেই। তবু তাড়াতাড়ি হাতে চুড়ি পরে নিলো।কিন্তু ক'দিন বাদে মকবুল সাহেব নিজেই বারন দিলেন পরতে।বলেন - প্রতিবার ওয়াশরুমে তোমার চুড়ি পাই। হয়তো হাত ধোয়ার সময় খুলে রাখো আর মনে থাকেনা।হারিয়ে যেতে পারে। তুমি বরং এগুলো তুলেই রাখো। মিরু হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
নতুন বউ, শশুরের সামনে শাড়ি পরার বিধান।অপরিপক্ক হলেও ঘরে মিরু শাড়ি পরে।একদিন বাবা দেখলেন মিরু আনাড়ি হাতে গ্যাসের চুলায় রান্না করতে গিয়ে বারবার আঁচল টানছে।একটু অসচেতন হলেই আগুন ধরে যেতে পারে। বাবা সেদিনই নিষেধ করলেন শাড়ি পরতে। মিরু যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পায়।
বাবা রাঁধতে খুব পছন্দ করেন।প্রায়ই এটা সেটা রান্না করে চমকে দেওয়ার চেষ্টা করেন। যেবার মিরু খুব অসুস্থ হলো বাবাই সমস্ত রান্নার দায়িত্ব নেন। খুব ছোটবেলায় মা'কে হারিয়ে নিজে রান্না করে স্কুলে যেতে হতো তাকে। সেই থেকে রান্নাটা ভালোই রপ্ত তার।সকালে মসজিদে নামাজ পড়ে বন্ধুদের সাথে জগিং এ যেতেন। পথের ধারে পড়ে থাকা বকুল,শিউলি কিংবা কৃষ্ণচূড়া কুড়িয়ে আনেন মিরুর জন্য। বিছানার পাশে ফুল দেখে প্রথমে মিরু ভেবেছিলো এটা শাহেদের কর্ম।কিন্তু পরে সত্যিটা জানার পর মিরু ভীষণ অবাক আর আপ্লূত হয়।
মিরু গল্পের ছলে জেনে নেয় কার কি খেতে পছন্দ। সেভাবে রান্না করে।একবার সে খেয়াল করলো মা মাছ খাচ্ছেন না।মিরু কারন জিজ্ঞেস করলে এটাসেটা কুযুক্তি দেখায়।তখন মিরু কাগজ কলম এনে বলে - আপনি কি কি মাছ খান বলেন, আমি সেগুলোই বাজার করবো।এরপর যেন আর না শুনি মাছ খাবো না। মা দুধ খেতে ভীষণ ভালোবাসেন।মিরু তাই বেশি করে দুধ এনে ডীপ করে রাখে।বাইরে গেলে মায়ের পছন্দের কোক, আইসক্রিম আনতে ভোলেনা সে।পুত্র আদিব তো ঠাট্টা করে বলে - আইসক্রিম হলো দীদার চার্জার। খেলেই কাজে এ্যাক্টিভ হয়ে যান। হাহাহা।
প্রতিদিন সকালে বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে যাবার সময় মা'কে কিছু মুখস্থ বুলি আওড়াতে হয়। মা আপনার বিছানার পাশে বিস্কিটের কৌটা, কলা, পানি রইলো। টেবিলে নাস্তা, চা আছে। বাবা ফিরলে একসাথে খেয়ে নেবেন। বাবার কাছে আলাদা চাবি আছে। কেউ কলিং বেল দিলে খুলবেন না যেন।আজকে আমি ফেরার আগে গোসলে যাবেন না। নখ বড় হয়েছে, কাটতে হবে। হাত পা ঘষে দেবো সাবান দিয়ে। মনে থাকবে তো? মা ঘাড় কাত করেন- বুঝেছেন।যদিও মিরু জানে সে না ফেরা পর্যন্ত মা নাস্তা করবেননা।তবে বাবার ডায়াবেটিস। তিনি নাস্তা সেরে নেন।
নিলুফা বেগমের খুব বাজে একটা স্বভাব আছে। যে কারনে মিরু প্রায়ই চিল্লাচিল্লি করে।মিরু বহুবার মাকে বলেছে নিজে হাত দিয়ে নিয়ে খেতে।কিন্তু কে শোনে কার কথা। বিরক্ত হয়ে মিরু বলে - মা, এটা যেমন আমার স্বামীর বাসা তেমনি আপনার নিজের পেটের সন্তানের বাসা।আপনি আমার আগে এসেছেন। আমিই বরং উড়ে এসে জুড়ে বসেছি।তাহলে আমি আপনার কাছে চেয়ে চেয়ে খাবো কেমন?
নিলুফা বেগম অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন - পাগল মেয়ে আমার কি বলে!
একদিন সকালে মা'কে কাপড়ের ব্যাগ গোছাতে দেখে কারন জিজ্ঞেস করলে বাবা বলেন তোমার মা ছোট ছেলে লাবুর ওখানে একটু যেতে চায়।মিরু কালবিলম্ব না করে হাতের ব্যাগ কেড়ে নেয়। স্পষ্ট হুকুম জারি করে - কাপড় নেওয়া চলবে না। লাবু সিঙ্গেল মানুষ। থাকে ছয়তলার উপর। আপনার গরমে কষ্ট হবে। সকালে গিয়ে সন্ধ্যার আগেই বাবার সাথে ফিরে আসবেন।আর কোনো কথা হবে না।
মিরুর ভালোবাসা খানিকটা ঝাঁঝালো ধরনের।যাকে সে মনপ্রান দিয়ে ভালোবাসে, তার বেলায় একটু খামখেয়ালি, আবদার, খবরদারী করে থাকে সে।বাইরের মানুষের কাছে সে স্বল্পভাষী,মুডি, অহংকারী। কিন্তু কাছের মানুষের জন্য তার উজাড় করা মায়া, আবেগ, মন জয় করার প্রানান্ত চেষ্টা। সবাই হয়তো তাকে সঠিক পরিমাপ করতে সক্ষম হয়না।তাতে কি! সে যেমন আছে তেমনই থাকতে চায়।
মা চলে যাবার পর মিরু ভীষণ মুষড়ে পড়ে।কেবলই মনে হয় কিছুই তো করা হলোনা।আরো কিছুদিন যদি কাছে পেতাম। মিরু মাকে প্রায়ই বলতো - আপনি যদি আমার প্রতি সন্তুষ্ট হন, তবে দোয়া করবেন আমি যেন আপনার মতো শাশুড়ি হতে পারি।আর যদি অসন্তুষ্ট হন, তবে অভিশাপ দেবেন যেন আমি আমার মতো পুত্র বঁধু পাই।দু'দিকেই আমার লাভ। হাহাহা।
তবে শত আক্ষেপের মাঝে স্বান্তনার কথা হলো মা মিরুর প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন।কিভাবে? একদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ মা মাথা ঘুরে পড়ে যান।চোখ খোলা অথচ তিনি কাউকে দেখতে পারছেন না।অবচেতন অবস্থায় ছেলে শাহেদকে উদ্দেশ্য করে বলেন - ও বাপ, মিরু কই, মিরু? ওরে শিগগির ডাক।ও আসলি পরে ( এলে) আমারে নিয়ে কি করবেনে! আমি সুস্থ হয়ে যাবানি"। কথাটা এখনো স্পষ্ট কানে বাজে মিরুর।জীবনে কি এমন পূন্য করেছে জানা নেই। অনেক সৌভাগ্য নিয়ে জন্মালে এমন বাবা, মা, সংসার কপালে জোটে।মনে হতেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে মিরু।এই শূন্যতা তাকে বয়ে বেড়াতে হবে আজীবন।।
কলমে - আরাফ সুলতান
Comments (0)