ঝোপঝাড় পেড়িয়ে যখন নিজেদের রঙিন ঘুড়িসমেত দুইবন্ধু খোলা মাঠে নামলাম, তখন চারিদিকে অন্ধকার নেমেছে। পেরিয়ে আসা ঝোপঝাড়ে অগণিত জোনাকি পোকা যেন আলোর খেলা খেলছে। জোছনা রাত, তার উপর আজ আবার পূর্ণিমা। আকাশে অসংখ্য ঘুড়ি বিভিন্ন রঙের উজ্জল আলো নিয়ে উড়ছে! দূর থেকে এমন মনে হচ্ছে যেন আকাশে তারার চেয়ে ঘুড়ির সংখ্যা বেশি।
নিজেদের রঙিন ঘুড়ি রঙিন আলোসহ উড়াবার পর কখন যে তিন ঘন্টা পেরিয়ে গেছে তা খেয়াল নেই। হঠাৎই এক দমকা বাতাসে ঘুড়ির সূতা গেল কেটে।
-রাজ বন্ধু! ঘুড়ির সুতো তো কেটে গেছে, অনেকদূরে গিয়ে পড়বে। কী করবি এখন? এখন না গিলে ঘুড়ি পাওয়া না যেতেও পারে।
-কী করবো মানে? আমি আপাতত ঘুড়ির অনুসরণ করে যাচ্ছি, তুই বাকি সুতোটুকু গুছিয়ে চলে আসিস। বললো রাজ।
-একাই যাবি, না মানে ঐ দিকে তো পূবের জঙ্গল। যদি জঙ্গলে গিয়ে পড়ে।
-তুই কি ভয় দেখাচ্ছিস?
-আহ, ভয় দেখাবো কেন? আচ্ছা সাবধানে যাস, আমি সুতো গুছানো হলেই চলে আসবো।
- হুমম, তুই তাড়াতাড়ি আসিস কিন্তু।
-আচ্ছা।
যতক্ষণে নাটাইতে সুতো গোছানো হলো, ততক্ষণে আর প্রায় চল্লিশ মিনিট কেটে গেছে। ফোনের স্ক্রিনে বেজেছে এগারোটা বেজে তিন মিনিট।
নাটাই হাতে, রাজ যেদিকে গেছে সেদিকে যেতে যেতে রাজকে ফোন দিলাম। কিন্তু যতবারই ফোন দিই ততবারই ফোন বন্ধ দেখাই। তখনই মনে হলো রাজ যেন একবারই আমার নাম ধরে জোরে ডাক দিল, পূবের জঙ্গলের দিক থেকে।
- কাব্য এদিকে আয়, ঘুড়ি পাওয়া গেছে।
- আসতেছি, তোর ফোন বন্ধ কেন?
কিন্তু কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। যেদিক থেকে রাজ ডেকেছে সেদিকে এগিয়ে গেলাম, তবে রাজকে পাওয়া গেল না। হঠাৎ মনে হলো আমি বাগানের অনেক ভিতরে চলে আসছি। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি একটা বাজতে আর কয়েক মিনিট বাকি আছে। আরে কিছুক্ষণ আগে না দেখলাম এগারোটা তিন বাজে। নিশ্চয় ফোনের সময় উলটপালট হয়ে গেছে, ফোনের ডাটা অন করতেই দেখি সময় তো ঠিকই আছে। তৎক্ষনাৎ শরীরের মধ্যে দিয়ে এক ঠান্ডা শিহরণ বয়ে গেল। এত সময় আমি কোথায় কাটালাম? মনে হলো কাছাকাছি কোথায় যেন কয়েকটি শেয়াল করুণ আর্তনাদে কেঁদে উঠল। কিছুটা ভয়ও করতে লাগলো।
হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখি রাজ অদ্ভুত ভাবে, যেন বহুদিনের ক্ষুদার্থ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
-তোর ফোন বন্ধ কেন? আর সেই কখন থেকে তোরে খুঁজছি? বললাম আমি।
-আগে গাছে উঠে ঘুড়িটা পারতো, তারপর বলছি?
আর কোনো কথা না বলে গাছে উঠতে শুরু করলাম। কয়েকধাপ উপরে উঠতেই আসেপাশে অনেক মানুষের কন্ঠস্বর, জোরে দৌড়ে আসার শব্দ শোনা গেল। রাজকে কী হয়ছে জিজ্ঞাসা করবো বলে নিচে তাকাচ্ছি, হঠাৎ মনে হলো আরে রাজ নিজেই তো আমার চেয়ে ভালো গাছে উঠতে পারে। কিন্তু ও নিজে না উঠে আমাকে উঠতে বললো কেন? তখনই নিচে দাঁড়ানো রাজের উপরে চোখ পড়লো, যেন আমার দিকেই এতক্ষণ তাকিয়ে ছিলো।
তখনই কিছুটা দূর হতেই কে যেন বলে উঠলো
-কাব্য গাছের উপরে আর উঠিস না।
আরে এটাও তো রাজের কন্ঠ, দূরে তাকিয়ে দেখি রাজ দৌড়ে আসছে। সাথে প্রায় আরও পনের-বিশজন মানুষ। তাহলে এতক্ষণ কার সাথে কথা বললাম। তৎক্ষনাৎ নিচে তাকালাম, এই রাজ এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দিয়ে যেন জ্বলন্ত আগুন ছুটছে, যেন বলছে আজকের মতো বেঁচে গেলি!
আর কিছু মনে নেই।
হঠাৎ কেউ আমাকে জোরে ঝাকুনি দিলো। চোখ মেলে তাকাতেই দেখি রাজ দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে সেই রঙিন ঘুড়িটা দেখা যাচ্ছে।
-এই অসময়ে ঘুমাচ্ছিস যে? আজ না ঘুড়ি উড়াতে যাওয়ার কথা।
-ওহ! তাহলে স্বপ্ন দেখছিলাম, বড় জোর বাঁচা বেচেছি।
আর কি যাবো ঘুড়ি উড়াতে? মোটেও না।
(সমাপ্ত)
Comments (0)