প্রায় বছর চারেক আগের ঘটনা। বন্ধু রাহাতের বড় ভাইয়ের বিয়ের নিমন্ত্রন পেয়েছি। ডিসেম্বর মাস প্রায় শেষ। তীব্র শীতের এক সকালে আরেক বন্ধু সামিরকে নিয়ে পৌঁছে গেলাম সাতক্ষীরা জেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রাম আশাসনীতে।বিয়ের উৎসব, সারা বাড়ি লোকে লোকারণ্য। গ্রামের বিয়ের অনুষ্ঠানে আলাদা একটা আমেজ আছে। এখানে অঞ্চলভিত্তিক নানা রীতির আনুষ্ঠানিকতা পালিত হয়।হরেক পদের পিঠাপুলির আয়োজন গ্রামের বিয়েতে বাড়তি মাত্রা যোগ করে।
যাহোক, বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতে হতে একটু বেশিই রাত হয়ে গেলো। ছাদে শামিয়ানা টাঙিয়ে স্বজনদের শোয়ার ব্যাবস্থা করা হলো।এদিকে সামির হঠাৎ বেঁকে বসলো।তার ঠান্ডার প্রবলেম তাই সে এই তীব্র শীতে কিছুতেই ছাদে শুতে পারবেনা। কি করা যায় ভাবনায় পড়ে গেলাম।রাহাতকে তো আর এই ঝামেলার মধ্যে নতুন করে প্যারা দিতে পারি না। সাতক্ষীরা বাজারের কাছে আমার এক নিকটাত্মীয়ের বাড়ি।বাড়িতে লোকজন বিশেষ কেউ নেই। মা ছেলের সংসার। হুট করে এত রাতে গিয়ে উঠলেও সমস্যা হওয়ার কথা না। একটা রাতেরই তো ব্যাপার।রাহাতকে ভুজুংভাজুং দিয়ে আমরা রাত সাড়ে বারোটার দিকে বেড়িয়ে পড়লাম। সাথে সাথে ভ্যান পেয়ে গেলে ঘন্টা খানেকের মধ্যেই পৌঁছে যাওয়ার কথা।
রাত দেড়টার দিকে আমরা ফুপু বাড়ি পৌঁছালাম।এটা আমার খালার শশুর বাড়ি। শশুর মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। বাড়ি বলতে গেলে প্রায় ফাঁকা।খালাতো ভাইয়ের ফুপু তাই আমিও সালেহা ফুপুকে ফুপু ডাকি।তিনি অসম্ভব ধৈর্যশীলা এক রমনী।ওনার মতো পরিশ্রমী আর ব্যাক্তিত্বসম্পন্না নারী আমি খুব কমই দেখেছি। এত অমায়িক তার ব্যাবহার! সদা হাস্যময়ী এই ফুপুর সংসারভাগ্য খুব বেশিদিন টেকেনি।অল্প বয়সে স্বামী হারিয়ে একমাত্র ছেলে সন্তান মারুফকে নিয়ে বাবার বাড়ি ফিরে আসেন।সেই থেকে বাবার সার্বক্ষণিক দেখভাল ফুপু নিজেই করেন।বাবার মৃত্যুর পর ফুপু ছেলেকে নিয়ে এই এতবড় গৃহস্থ বাড়ি দেখেশুনে রাখছেন।ভাইবোনেরা বছরে একবার কি দুবার শহর থেকে বেড়াতে এলে সালেহা ফুপু সর্বোচ্চ দিয়ে তাদের আপ্যায়ন করার চেষ্টা করেন। ফুপুর যে দিকটি আমাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে তা হলো তিনি বছরের হারাম দিনগুলো বাদে পুরো বছর ধরেই রোজা রাখেন। সালেহা ফুপু আমাকে ভীষণ আদর করতেন।বেশ কয়েকবার খালার সাথে এ বাড়িতে বেড়াতে এসেছি আমি।
একে তো গভীর রাত, তার উপর গাছগাছালি ঘেরা জংলা এলাকা।চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার।কোথায় যেনো প্যাঁচা ডাকে।কেমন গা ছমছমে পরিবেশ। আমগাছ, বাঁশঝাড় ছাড়িয়ে মেঠো পথ দিয়ে আমরা এগিয়ে যাই নিদিষ্ট গন্তব্যে। বাইরে থেকে সালেহা ফুপু
বলে হাঁক দিতেই ফুপু হাসিমুখে বেরিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।বিনা নোটিশে আমাদের দুজনকে এত রাতে দেখেও তার ভেতরে কোনো কৌতূহল কিংবা অবাক ভাব চোখে পড়লো না। মনে হচ্ছিলো তিনি আগেই জানতেন আমরা আসবো। কি জানি, হয়তো পাশের গ্রামে বিয়ের দাওয়াতে আসার খবর খালার কাছ থেকে তিনি পেয়ে থাকতে পারেন।
আমরা আর কালবিলম্ব না করে ফুপুকে অনুসরণ করে ঘরে প্রবেশ করলাম।মারুফকে দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম সে কোথায়।ফুপু জানালেন ওর তো ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। ঢাকায় মামাদের বাড়ি বেড়াতে গেছে।
তাই বলে মাকে একা ফেলে? কথাটা মনে এলেও মুখে কিছু বললাম না। এত রাতে খবর না দিয়ে সেখানে আগমনের কারন বলতে গেলে ফুপু হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বলেন - ওসব পরে হবে।আগে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।কিছু খেয়ে নিয়ে স্থির হয়ে বসো তো। গল্প করার জন্য সারারাত পড়েই আছে।আমি বরং তোমাদের জন্য খাবারের ব্যাবস্থা করি। গালভরা হাসি দিয়ে ঘরের বাইরে পা রাখতে উদ্যত হন তিনি।
আমি পিছু ডেকে বললাম ফুপু,আপনি অযথা ব্যাস্ত হবেন না।আমরা সন্ধ্যেবেলায় পেটপুরে বিয়ে বাড়ির খাবার খেয়ে এসেছি।
- সেই সন্ধ্যে বেলায় তো! এখন ক'টা বাজে সে খেয়াল আছে? আর পিছু ডাকা খুব বাজে অভ্যাস বাবন!
ফুপু আমার খালাতো ভাইদের ও বাবন ডাকেন।বাবা কিংবা বাপ নয়।
আমি আর সামির ফুপুর নির্দেশ মেনে কাপড় চেঞ্জ করে কলপাড়ে গেলাম হাতমুখ ধুতে।চারিদিকে এত সুনসান নিস্তব্ধতা আর জঙ্গলে ঘেরা যে কোনো কারন ছাড়াই অজান্তে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো।আমি একবার ভালো করে চারদিকটা দেখে নিলাম।খোলামেলা বিশাল জায়গা নিয়ে বাড়িটায় কোনো সীমানা প্রাচীর নেই। এই অঞ্চলে চুরি ডাকাতি হয়না নাকি!
ঘরে ঢুকেই দেখি বিছানায় নতুন চাদর বিছিয়ে তার উপর হরেক পদের খাবার সাজানো।গরম ধোঁয়া ওঠা সাদা ভাত,করলা ভাজি ( আমার ভীষণ পছন্দের) , সরষে দিয়ে বোয়াল মাছের বড় পেটি, নারকেল দুধে গলদা চিংড়ির মালাইকারি, পাটশাকে মশুর ডাল চচ্চড়ি আরো কি কি সব পদ। বাপ্রে! এত রাতে এই অল্প সময়ে এতসব আয়োজন করলো কি করে ফুপু? আমরা তো পুরোপুরি হতভম্ব। ফুপু কে জিজ্ঞেস করলাম - এতসব খাবার কি আমাদের দেখে রান্না করলেন নাকি দুপুরেই রান্না করা ছিলো? আপনি একা মানুষ, এগুলো কখন আর কিভাবেই বা রান্না করলেন?
ফুপু তার সেই স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে কপোট রাগের ভঙ্গিতে বললেন - এসব নিয়ে তোমাকে মাথা না ঘামালেও চলবে। ঝটপট খাওয়া শুরু করো তো বাবন। আমি পিঠাগুলো নিয়ে আসছি।
- আবার পিঠা? পিঠা করলেন কখন? দেখলাম নাতো!
বাইরে ইশারা করে বললেন - ঐ যে দেখো বাইরে এখনো উনুন জ্বলছে। তাড়াতাড়ি যাই নইলে সব পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।আবারো মনভোলানো হাসি দিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করলেন।
আমি আর সামির আয়েশ করে খেতে বসলাম।খাবারের সুঘ্রাণে প্রান পুরাই মাতোয়ারা। এতক্ষণে খেয়াল হলো পেটে আসলেই ইঁদুর দৌঁড়াচ্ছে। ঝটপট দু'জনে খাওয়া শুরু করলাম।আহা! প্রতিটা পদ এত বেশি সুস্বাদু, আমি আর কোনোদিক না তাকিয়ে গপাগপ শুধু গিলছি।কেমন মন্ত্রমুগ্ধের মতো খেয়ে যাচ্ছি তো যাচ্ছি। একটু পর খেয়াল হলো সামির এঁটো হাতেই ধীরে ধীরে কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছে। ওর চোখ দুটো বড় বড় আর গলা দিয়ে গড়গড় শব্দ বের হচ্ছে।গলায় কিছু আটকে গেলো কিনা ভেবে ওকে বারবার ঝাঁকাচ্ছি। সে কোনো কথাই বলতে পারছেনা শুধু গোঙানির মতো শব্দ করছে।এরপর সারা শরীর কাঁপা কাপি শুরু হলো।ওর কম্পনে বিছানাশুদ্ধ কাঁপছে। সামিরের মৃগী রোগ আছে জানতাম নাতো! আমি ভীষণ ঘাবড়ে গেলাম। ফুপুকে কয়েকবার ডেকেও সাড়াশব্দ পেলাম না।হয়তো কাছাকাছি কোথাও নেই।
অনেকক্ষণ ধরে সামিরের হাত পা মাসাজ করার পর সে ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসে।তবে সারারাত ও কোনো কথা বলেনি।আমারও জানা হলোনা আচানক ওর এমন কেনো হলো।ঘরের লাইট জ্বেলেই এক পাশে জবুথবু হয়ে ঘুমের ভান করে পড়ে রইলো।আমার আর সারারাত ঘুম হলোনা। আকাশ পরিষ্কার হতেই রওনা করতে হবে।কাছাকাছি ভালো কোনো হাসপাতাল থাকার কথা না। আর এত সকালে কোনো ডাক্তার নিশ্চয়ই চেম্বারে বসবে না। সিদ্ধান্ত নিই যশোরে খালার বাসায় গিয়ে খালুজানকে সাথে নিয়ে সামিরকে ভালো কোনো ডাক্তার দেখাবো। তাই কালবিলম্ব না করে ফুপুর কাছে বিদায় নিয়ে তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়লাম। ফুপু অবশ্য বারবার অনুতাপ করছিলেন - হঠাৎ করে কি হলো ছেলেটার? রান্নায় কোনো সমস্যা ছিলো কিনা। আমি আস্বস্ত করে বললাম- কি যে বলেন ফুপু! একই খাবার তো আমিও খেলাম। মনে হয় ওর মৃগী ব্যারাম আছে।
যাহোক, ঘন্টা তিনেক বাস জার্নি করে আমরা যশোরে খালার বাসায় পৌঁছালাম। এত সকালে আচমকা খবর না দিয়ে আসায় খালা ভুত দেখার মতো চমকে উঠলেন।
সবার হাতে হাতে মোবাইল। একটা খবর কি দিয়ে আসা যেতো না? খুব অভিমান হলো পারভীন খালার।আমি খুব সংক্ষিপ্ত আকারে গতকালের সব ঘটনা খুলে বললাম।শুনে খালাম্মা, খালুজান তো প্রায় স্ট্যাচু হয়ে যান।
- কি বলিস এসব? বাড়ি গেছিলি মানে? কার বাড়ি...কোথায় রাত কাটিয়েছিস?
- কার বাড়ি আবার, তোমার শশুর বাড়ি। সালেহা ফুপুর ওখানে।
খালা খালুজান দুজন দু'জনের দিকে চেয়ে থ হয়ে গেছেন।
এমন সময় আমার চোখ যায় বাইরে উঠানে।সালেহা ফুপু এখানে কি করে? তিনি গোসল সেরে রোদে কাপড় মেলে দিচ্ছেন। আমার গা ঝিমঝিম করতে লাগলো।চোখ ভালো করে কচলে আবার তাকালাম।ফুপু এবার ঘরে ঢুকে আমাকে দেখে বিস্মিত কন্ঠে বললেন- কি রে বাবন, এত সক্কাল সক্কাল কোথা থেকে এলে? তুমি আসবে, পারভীন কিছু জানায়নি তো!
এতক্ষণে সামিরের জবান খুললো।আমার শার্ট খামচে টেনে ধরে ওর দিকে মুখ ফেরালো- কাল থেকে তো আমি সে কথাই বলতে চাচ্ছি। রাতে খেতে বসে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি ফুপু চুলার পাশে বসে পিঠা করছেন। আমি স্পষ্ট দেখলাম ফুপুর পা দুটো চুলার মধ্যে ঢুকানো।জ্বালানির বদলে পা দিয়ে আগুন জ্বলছে। আমি মোহগ্রস্তের মতো তাকিয়ে থাকি।দেখি ওনার বা হাতটা উঁচু হতে হতে পাইপের মতো লম্বা আর সরু হয়ে উপর থেকে দুটো নারকেল পেড়ে আনলো।আর কিছু আমার মনে নাই।
সামিরের জবান নিঃসৃত এই মহান বানী শোনার পর পেটের মধ্যে গুরগুর শুরু হলো।সুস্বাদু খাবার, পিঠা সব গুলিয়ে উগরে আসতে চায়। আচমকা আমার দাঁত কপাটি লেগে যায়। এরপর কয়দিন জানি আমার হুঁশ আছিলোনা !!
কলমে - আরাফ সুলতান
Comments (0)