আমার আব্বা অত্যন্ত সহজ-সরল প্রকৃতির মানুষ। বাজার করতে গেলে দোকানদার যদি গাজরকে মুলা’র নতুন জাত বলে ব্যাগে ঢুকিয়ে দেয় তবে আব্বাও খুশিতে গদগদ করতে করতে ঘরে ফিরে আসবে। আম্মার কিংবা আমরা দুই ভাইয়ের সাধ্যি নেই গাজরকে গাজর প্রমাণ করার। আম্মাও একসময় হাল ছেড়ে দিয়ে সেই গাজরকে মলা কিংবা ঢেলা মাছের সাথে রান্না করে। তবে আব্বার এই সহজ-সরল প্রকৃতির চরিত্রটা শুধুমাত্র বাইরের লোকজনের জন্য।
ভেতর ভেতর আব্বা অত্যন্ত ঘাড়ত্যাড়া। একটু উদাহরণ দেই। সেইবার আব্বা বাজার থেকে শোল মাছ আনলেন, ফুলকপি দিয়ে খাবেন বলে। দুপুরে খাওয়ার টেবিলে আমি আর টগর ভাইয়ার প্রশংসায় পঞ্চমুখ আম্মা। আমাদের এহেন কাণ্ডজ্ঞান দেখে আব্বা খাওয়ার টেবিল থেকে উঠে রান্নাঘর থেকে একটা বয়াম নিয়ে আসলেন। আম্মা কিছু বলার আগেই আব্বা শোল মাছ ভর্তি বাটিতে লবন ছিটিয়ে দিতে দিতে বললেন,' এ-ই তোমার রান্না! লবন না হলে বিরিয়ানীর মজা নেই আর তুমি কি'না লবন ছাড়া শোল মাছ রেঁধে ছেলেদের বাহবা কামাচ্ছ!" আম্মা জানেন পরিমাণ মতো লবন হওয়া স্বত্বেও আব্বার এমন আচরণের কারণ আমরা দুই ভাইয়ের প্রশংসা। তাই তিনি চুপ করে থাকলেন।
আব্বা পুনরায় নাক ছিটকতে ছিটকতে খাওয়া শুরু করলেন। টগর ভাইয়া প্লেটে আবার মাছ নিতে নিতে বললেন,' লবন কেউ বেশি খায়, কেউ কম। আমি কম খাওয়াদের দলে। তাই আমার জন্য পারফেক্ট ছিল। আব্বা আবার লবন দেওয়ায় আগের স্বাদটা পাব না।'
আমি আর আম্মা পুনরায় মাছ নেওয়া থেকে বিরত থাকলাম। টগর ভাইয়া এক লোকমা ভাত মুখে দিয়েই ওয়াক থু করে ফেলে দিলেন। আমি হাসতে গিয়েও আব্বার চোখ রাঙানোর কথা মনে করে হাসতে পারলাম না।
আব্বা চেঁচিয়ে টগর ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন,' এমন লবন দিই নাই যে তোর ওয়াক করতে হবে।'
আম্মা বললেন, 'লবনের পরিবর্তে তরকারিতে চিনি দিলে ওয়াক তো করতেই হবে।'
আব্বা মানতে নারাজ। তিনি কড়া গলায় বললেন," আমি লবনই দিয়েছি চিনি নয়।''
আম্মা বললেন,' রান্নাঘরের সবকিছু আমার হাতেই সাজানো তাই আমি বেশ ভালো জানি, কোন বয়ামে লবন থাকে, কোন বয়ামে চিনি।"
আব্বা আমরা দুই ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,' দেখ তোদের মায়ের অবস্থা দেখ। একজন পঞ্চাশোর্ধ বয়সী পুরুষ মানুষকে লবন আর চিনি চিনচ্ছে।"
আমি আব্বার কানে কানে বললাম,' আব্বা ঘরে মানুষ আছি চারজন। টগর ভাইয়া আপনার চিনিকে কখনো লবন বলবে না। আমিও যেটা সত্য সেটা বলতেই পছন্দ করি। তবে আপনি চাইলে আপনার দলের হয়ে কথা বলতে পারি। এতে দু'দলের সদস্য সমান সংখ্যক হবে। বিকালে পাঁচশ টাকা দিয়েন।"
আব্বা আমার প্রস্তাবে রাজি হয়েছেন সেটা বুঝাতে বললেন,' দেখ তো সাগর তুই একটু টেস্ট করে দেখ। চিনি নাকি লবন।'
আমি এক চামচ ঝোল টেস্ট করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে বললাম,' আম্মা, পঞ্চাশোর্ধ একজন পুরুষ মানুষ লবন আর চিনির পার্থক্য বুঝতে পারবে না! অসম্ভব, এটা হতে পারে না।"
আম্মা নিরীহ প্রকৃতির মানুষ। সবসময়ই একটু শান্তিতে থাকতে চান। তাই আব্বার ঝগড়া মূলক শব্দ বাক্য আম্মা কানে তোলেন না। আমার আব্বা ছোট থেকেই গুরুতরভাবে একজন আওয়ামী লীগ ভক্ত। অন্যদিকে আব্বাকে টপকে যেতে টগর ভাইয়া ইদানীং বিএনপি, বিএনপি করে গলা ফাটায়। ঘরে আমার অবস্থান অতিরিক্ত এরশাদ টাইপের। প্রকাশ্যে আব্বার, অপ্রকাশ্যে ভাইয়ার। ভেতর ভেতর নিজের। মাঝেমধ্যে আম্মার।
টগর ভাইয়া গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে একটা ভালো বেতনের চাকরি করছেন। আর আমি সদ্য একুশ পেরিয়ে বাইশে পা দেওয়া যুবক। গত এক বছর ধরে আম্মা, আব্বা ভাইয়াকে বিয়ে দিতে উঠে-পড়ে লেগেছেন। ভাইয়ার পাত্রী পছন্দ হলে আব্বার বেয়াইন পছন্দ হয় না। আব্বার বেয়াইন পছন্দ হলে ভাইয়ার পাত্রী পছন্দ হয় না। পাত্রী দেখাদেখিতেও আব্বা আর ভাইয়ার মাঝে রাজনৈতিক তান্ডব চলতে থাকে। তাদের সাথে পাত্রী দেখতে যেতে যেতে দু'চারটা পাত্রী আমার নিজেরই পছন্দ হয়ে যায়। আফসোস লাগে ভাইয়ার জন্য এত সুন্দর সুন্দর পাত্রী কিভাবে হাত ছাড়া করে তা ভেবে!
আজ ভাইয়ার জন্য উনিশ তম পাত্রী দেখতে যাব। আম্মা পাত্রী দেখতে দেখতে ক্লান্ত। তাই এবার আর যাচ্ছে না। টগর ভাইয়া আমি আর আব্বা দুপুরে খেয়ে-দেয়ে রওনা দিলাম।
পাত্রীর বাড়িতে চা নাস্তা খাওয়ার পর কিছুক্ষণ গল্পসল্প হলো তারপর পাত্রী দেখলাম।
এইবার আব্বার যেমন বেয়াইন পছন্দ ভাইয়ারও তেমন পাত্রী মানে বউ পছন্দ হলো। কিন্তু দুইজনে দুই দলের হওয়ায় সিদ্ধান্ত নেওয়াটা কঠিন হয়ে পড়লো। আব্বা অযথা একটু পর পর নাক চুলকচ্ছেন। হয় তো নতুন বুদ্ধি উদয় কিংবা হারজিতের হিসাব নিকাশ কষছেন। অন্যদিকে ভাইয়া একবার আড়চোখে পাত্রীর দিকে তাকায় আবার কঠিন চোখে আব্বার দিকে তাকায়। বেচারাও হয়তো লাভ লোকসান বোঝার চেষ্টা করছে।
আব্বা, মায়ের দেওয়া আংটিটা পকেট থেকে বের করে আমার হাতে দিল ভাইয়াকে দেওয়ার জন্য। আমি আব্বাকে ফিসফিসিয়ে বললাম," যার আংটি তার হাতে দিয়ে দেওয়ায় তো উচিত। শুধু শুধু এই হাতে, ঐ হাতে আংটিটা ঘুরানোর কি দরকার!"
পাত্রীকে আমি আংটিটা পরিয়ে দিতেই সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠল। পাত্রীর বাবা আমার আব্বাকে উদ্দেশ্য করে বললেন," বিয়াই, আমার মেয়ে লেখাপড়ায় অনেক ভালো। আপনাদের কাছে একটাই অনুরোধ বিয়ের পর মেয়ের লেখা পড়া বন্ধ করবেন না।"
আব্বা কিছু বলার আগেই আমি গলার স্বরটা পরিস্কার করে বললাম," আংকেল আপনি লেখাপড়া নিয়ে একদম ভাববেন না। আপনার মেয়ের লেখাপড়া নিয়ে অবহেলা করব না। এই যে আমার ছোট ভাই সাগর ( ভাইয়াকে দেখিয়ে দিয়ে বললাম) ও কিন্তু লেখাপড়ায় অনেক ভালো। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। যতটুক শুনেছি আপনার মেয়েও দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। কোনো সমস্যা হবে না।"
পাত্রীপক্ষের একজন লোক আব্বাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন," আরে বিয়াই সাহেব, আমরা তো এতক্ষণ আপনার ছোট ছেলেকে পাত্র বলেই ধরে নিয়েছিলাম।" লোকটা সম্ভবত পাত্রীর খালু, জেঠু টাইপের কেউ হবে। আব্বা বললেন," না, না, বিয়াই সাহেব আসলে আপনারা ভুল ভাবছেন পাত্র আমার বড় ছেলে...!" আব্বা পুরো কথা শেষ করার আগেই আরেকজন বলে উঠলেন," ঠিক আছে বিয়াই সাহেব। মানুষ মাত্রই ভুল। আসলে আপনার বড় ছেলের চেয়ে ছোট ছেলেটা একটু স্বাস্থ্যবান তো তাই যে কেউ এই ভুলটা করে পেলার মতোই।"
আব্বা আর কিছু বললেন না।
বাড়ি ফেরার পথে আমরা গাড়িতে কেউ কারোর সাথে কোনো কথা বললাম না। যদিও আমি ভাইয়ার সাথে ভাব করে ফেলার চেষ্টা করেছিলাম দু-একবার। কিন্তু ভাইয়া পাত্তা দিলেন না।
ঘরে পা রাখতেই ভাইয়া অগ্নিমূর্তির রুপ ধারণ করেন। যেন এক্ষুনি আমার গর্দান নিতে পারলেই বাঁচে এমন অবস্থা । রাগে ক্ষোভে ফোঁপাতে ফোপাঁতে ভাইয়া আম্মাকে বিস্তারিত ঘটনা খুলে বলার পর আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন," তুই এটা কেমনে করলি সাগর? তুই আমার কেমন ভাই? "
আমি ভাইয়ার পাশ ঘেঁষে বসতে বসতে বললাম," এরশাদ টাইপ ভাই! যে প্রকাশ্যে আব্বার, অপ্রকাশ্যে আপনার, মাঝেমধ্যে আম্মার, ভেতর ভেতর নিজের!"
Comments (0)