Search

গল্পঃ মুক্তি

  • Share this:

রিমির দিকে প্রায়শই বাড়ির কেয়ারটেকার আক্কাস আলী কুদৃষ্টিতে তাকায়। রিমির ছোট্ট মনটি বিষয়টি বুঝতে পারলেও কাউকেই কিছু বলে না। বাসার মালির কাজ করা রহিমকে রিমি ভালোবাসে এমনকি রিমিকেও রহিম ভালোবাসে। কিন্তু পরস্পরের কেউই কাউকে কিছু মুখফুটে বলতে পারেনা।

রিমির মা এককালে এই বাড়িতে কাজ করতেন কিন্তু কোনো এক অজানা রোগের কষাঘাতে পরে তিনি মারা গিয়েছিলেন। বাড়ির মালিক সিয়াম সাহেব তখন ছোট্ট বাচ্চা রিমিকে নিজের বাসায় নিয়ে আসেন। তিনি যখন রিমিকে নিয়ে আসেন তখন রিমির বয়স কেবল সাত বছর আবার অন্যদিকে সিয়াম সাহেবের ছেলের বয়স মাত্র দুবছর। সিয়াম সাহেবের স্ত্রী তাঁর ছেলেকে জন্ম দেওয়ার পরক্ষণেই মারা যান। তখন তাঁর ছোট্ট ছেলেকে দেখাশোনা করার জন্য একজন বিশ্বস্ত মহিলার প্রয়োজন ছিলো কিন্তু কাউকেই তিনি বিশ্বস্ত হিসেবে পাননি। তাই সবকিছুকে মাটি চাপা দিয়ে তিনি সাত বছর বয়সী অবুঝ রিমিকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন,

-শোনো রিমি, তুমি এখন থেকে আমাকে বাবা বলে ডাকবে। আর তোমার এই ছোট্ট ভাইটির সবসময় খেয়াল রাখবে। আজ থেকে তুমি ভাববে এটাই তোমার পরিবার।

সিয়াম সাহেবের কথায় তখন পিতৃমাতৃহীন ছোট্ট রিমির মন অনেক কিছু না বুঝলেও তাঁর অন্তরস্থলে কিছুটা আশার সঞ্চার হয়েছিলো এই ভেবে যে,

-যাক আমারতো একটি আশ্রয়ের স্থান হলো, এখন আমাকে অন্যান্য ছেলেমেয়েদের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে মানুষের নিকট হাত পাততে হবেনা।।

.

এখন রিমির বয়স চৌদ্দ বছর। বয়ঃসন্ধিকালের বৈশিষ্ট্যগুলোও বেশ ফুটে উঠেছে ওর শরীরে। আর এতবড় এক রাজমহলের ন্যায় বাড়িতে থাকার ফলস্বরূপ ওর চেহারার চাকচিক্যটাও বেশ দেখা যাচ্ছে। যে কেউ দেখলেই বলবে ও যেন এই বাড়িরই কর্তার মেয়ে।

সেদিন সিয়াম সাহেবের ছেলে সাবিককে স্কুলে দিয়ে এসে যখন রিমি বাড়িতে উপস্থিত হলো তখন বাসায় আক্কাস আলী ব্যতীত আর কাউকে দেখতে পেলোনা। রিমি পুরো বাড়িতে রহিমকে খোঁজার বৃথা চেষ্টা করেও যেন ওকে পেলোনা। হঠাৎই আক্কাস আলী রিমির ঘরে ঢুকেই রিমিকে অনেকটা অবজ্ঞার স্বরে বলে উঠলো,

-কীরে! তুইতো এখন বস্তির মাইয়া থিকা রাজকন্যা হইয়া যাইতাছোস। আস্তে আস্তেতো খাসা মা* হইতাছোস।

আক্কাস আলীর এহেন অশ্লীল মন্তব্য শুনে রিমি ক্ষানিকটা ঘাবড়ে গেলেও পরক্ষণেই বলে উঠলো,

-চাচা আপনি এহন যানতো। আমি কিন্তু আব্বুরে সব বইলা দিমু।

-উহ! দেখছোনি মাইয়ার ভাব। আব্বু মা*ইতেছে আবার। ঐ ছেমড়ি উনি কী তোরে জন্ম দিছে?

এসব কথোপকথন শুনে রিমি অনেকটা হন্তদন্ত হয়ে যেই রুম থেকে বের হতে যাবে ঠিক তখনি অনেকটা শক্ত করে রিমির হাতটা ধরে ফেললো আক্কাস। সেদিন আক্কাস আলীর হিংস্রতা থেকে রিমি নিজের সতীত্বকে রক্ষা করতে পারেনি। আক্কাস আলী যখন বুঝতে পারলো সে এক বড্ড খারাপ কাজ করে ফেলেছে তখন কোনোকিছু না ভেবেই বাড়ি থেকে পালিয়েছিলো সে। পরবর্তীতে রহিম রিমির এসব ঘটনা শুনে সেও যেন রিমির থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো। কারণ সে কেনইবা একটি ধর্ষিতা মেয়েকে ভালোবাসবে কিংবা বিয়ে করবে? সমাজেতো ওর এখন কোনো মূল্যই নেই।

এরপর সিয়াম সাহেব রিমিকে অনেক জায়গাতে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেও যেন পারলোনা। কারণ একজন ধর্ষিতা মেয়েকে কেই বা বিয়ে করবে? একপর্যায়ে রিমি সিয়াম সাহেবকে বললো,

-আব্বু! আমারে যদি আপনার বোঝা মনে হয় তাইলে আমারে রাস্তায় ফেলাইয়া দিয়া আসেন তবুও আমার কোনো আফসোস নাই। আর যদি বোঝা না মনে হয় তাইলে সারাজীবন আমি আপনের বাসায় কাজের লোকের মতো থাকতে চাই। দয়া কইরা আমারে বিয়া দেবার চেষ্টা কইরেন না। আমি আমার ভাইরে নিয়া অনেক ভালো আছি।

সেদিন সিয়াম সাহেব রিমির কথা শুনে আর কখনোই রিমির বিয়ের জন্য সামনে এগোননি।

.

এভাবে কেঁটে যায় পনেরো বছর,

সাবিক বিয়ে করেছে একটি শিক্ষিত মেয়েকে। সাবিক ও তাঁর স্ত্রী দুজনই চাকুরীতে ব্যস্ত থাকে সর্বদা। একসময় সাবিকের স্ত্রী গর্ভবতী হয় এবং কয়েকমাস পরেই সে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়।

একদা সাবিক তাঁর সন্তানসহ রিমির নিকট এসে বলে,

-আপু, তুমিতো জানোই আমি আর রূপা সারাদিন অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকি তাই আমাদের বাবুটার ভালোমতো যত্ন নিতে পারিনা। আজ থেকে সিজানকে তোমার নিকট তুলে দিলাম। তুমি যেমনটা আমাকে বড় করেছিলে ওকেও ঠিক তেমনিভাবে বড় করবে।

ছোট্ট নিষ্পাপ সিজানকে দেখে রিমি আর সেদিন নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি বরং মায়ের স্নেহে সে সিজানকে নিজের উষ্ণ কোলে জড়িয়ে ন্যায়।

আস্তে আস্তে সিজান বড় হয় আর একটা সময় সে রিমিকেই নিজের প্রকৃত মায়ের আসনে বসিয়ে ফেলে আর রিমিকেই সে মা বলে সম্বোধন করে।

.

এভাবেই কেঁটে যায় আরো পঁচিশ বছর...

সিজানও এখন বিয়ে করেছে নিজের পছন্দসই এক সুন্দরী শিক্ষিত মেয়েকে। অবাক করা বিষয় হলো সিজান এবং তাঁর স্ত্রী উভয়েই সর্বদা চাকুরী নিয়ে ব্যস্ত থাকে এমনকি এতোটাই ব্যস্ত থাকে যে শুধুমাত্র রাতের বিশ্রামটুকু ব্যতীত তাঁদের ফ্রি হবার সুযোগ নেই। একটা সময় সিজানের স্ত্রীও গর্ভবতী হয় এবং কিছু মাস পরেই সেও একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়। বেশ কয়েকমাস সিজানের স্ত্রী সারা তাঁর পুত্রকে সময় দিলেও আবারও সে চাকুরীর কাজে ব্যস্ত হয়ে পরে।

একদিন সিজান তাঁর স্ত্রী আর সন্তানসহ রিমির নিকট এসে বলে,

-আম্মু, আমাদের বিষয়টাতো তুমি জানো যে আমরা কাজে কতটা ব্যস্ত থাকি। এই নাও সজীবকে তোমার হাতে তুলে দিলাম। আমি জানি ওকে তোমার মতো আর কেউই বড় করতে পারবেনা। আমাকে যেমন মায়ের আদরে বড় করেছো ওকেও ঠিক সেভাবেই বড় করবে।

সেদিন ফুটফুটে সজীবকে দেখে রিমি আর নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি বরং নিজের বুকের উষ্ণতায় সজীবকে আগলে নিয়েছিলো সে। আস্তে আস্তে সজীবও বড় হয় এবং সে রিমিকে নিজের দাদিমা বলে সম্বোধন করে এবং নিজের বিশ্বস্ত মানুষ হিসেবে রিমির কোলেই ঝাপিয়ে পরে।

.

এভাবেই কেঁটে যায় আরো পঁচিশ বছর...

সজীবও তাঁর পুর্বসূরীদের ন্যায় বিয়ে করে এক সুন্দরী শিক্ষিত সানিয়া নামের মেয়েকে। অবাক করা বিষয় হলো সজীব ও সানিয়াও আগের ব্যাক্তিদের ন্যায় সর্বদাই চাকুরীতে ব্যস্ত থাকে। এমনকি অনেক সময় তাঁরা রাতেও বাড়িতে থাকেনা ব্যস্ততার খাতিরে। একটা সময় সানিয়াও গর্ভবতী হয় এবং কয়েকমাস পর সে একটি মেয়ে সন্তানের জন্ম দেয়। কিছুমাস পর সানিয়া তাঁর বাচ্চা মেয়ের যত্ন করার পর ভাবে,

নাহ আর মেয়ের জন্য এভাবে বসে থাকলে চলবেনা। আমাকে আবারো চাকুরী করতে হবে।

এসব ভেবে একদিন সজীব ও সানিয়া রিমির নিকট এসে কিছু বলার আগেই থুনথুনে বুড়ি রিমি বলে উঠে,

-বুঝতে পেরেছি তোমরা কী জন্য এসেছো। দাও তোমাদের মেয়েকে। আর তোমরা চাকুরী করো যাও।

কিছু না বলেই ফুটফুটে মেয়েটিকে সজীব এগিয়ে দেয় তাঁর দাদিমায়ের দিকে এবং পরক্ষণেই তাঁরা দুজন স্থান ত্যাগ করে চলে যায়। রিমি ফুটফুটে মেয়েটির কপালে তাঁর বুড়ো নরম ঠোটের চুমু খেয়ে দুফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিয়ে ভাবে,

-আমি শুধু সবার যত্নই নিয়ে গেলাম সবার প্রয়োজনই থেকে গেলাম অথচ আমার যত্ন নেওয়ার মানুষতো কেউই নেই। আচ্ছা আক্কাস যদি আমার কলঙ্কের দাগ না লাগাতো তাহলে কী রহিম আমাকে বিয়ে করে আমাকেও এদের মতোই ব্যবহার করতো নাকি ভালোবেসে নিজের বুকের মাঝে আগলে রাখতো?

এসব ভাবতে ভাবতেই একটা সময় বুড়ি রিমির শরীরটা নিস্তেজ হয়ে নরম বিছানায় নুইয়ে পরলো। সজীব অন্য রুম থেকে নিজের মেয়ের কান্নার আওয়াজ শুনে রিমির ঘরে এসে দেখে তাঁর মেয়েটি শুয়ে শুয়ে কাঁদছে আর পাশেই তাঁর দাদিমার নিথর দেহটি পরে আছে। সে এখন তাঁদের থেকে মুক্ত হয়ে আকাশের নীল দর্পণে হারিয়ে গেছে। আর কোনো উত্তরসূরীই তাঁর মায়ায় আবদ্ধ হতে পারবেনা সে এখন তাঁদের এই বেড়াজাল থেকে মুক্ত। এটাইতো হবার কথা ছিলো। তাই নয় কি?

.

(সমাপ্ত)

.

Misk Al Maruf

Tags:

About author
আমি গল্প এবং বই প্রেমিক একজন মানুষ। গল্প এবং বই পড়তে খুবই ভালোবাসি। যেখানেই যে গল্প অথবা কাহিনী খুজে পাই সেগুলো সংগ্রহ করি এবং আপনাদের সাথে শেয়ার করার চেষ্টা করি। আমি নিজেও কয়েকটি গল্প লিখেছি তবে সেগুলোর সংখ্যাটা খুবই সামান্য।