কি রে? এখানে এভাবে ভিজছিস কেন??
বলতে বলতে সামনে এগিয়ে এলো রক্তিম। সত্যিই তো এখানে কি করছি আমি?
হঠাৎ মনে হলো বসন্তের শেষটায় বেশ ঝড় হাওয়া বইছিল, আকাশ ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। আশে পাশে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে বোধ হয়, বেশ ঠান্ডা বাতাস। এমন সুন্দর আবহাওয়ায় ঘরে বসে থাকার ছেলে আমি না। এদিকে লকডাউন আর রক্তিমও তো ঘুমাচ্ছে। একা বাহিরে যাওয়া কি ঠিক হবে?? সাত-পাঁচ না ভেবেই বেড়িয়ে পড়েছিলাম। রক্তিম আমার ছোট বেলার বন্ধু আর সব বন্ধুদের মাঝে ওই ই এখনও সাথে আছে। সে অবশ্য আমার রুমমেট হওয়ার সুবাধেই। অত্যন্ত পেটুক প্রকৃতির একটা ছেলে তবে মনটা অনেক ভালো। ঝড় হাওয়াতে রাস্তায় হাটছিলাম বেশ ভালোই লাগছিলো। হাটতে হাটতে আমার প্রিয় জায়গাটায় এসে বসলাম। বৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছে। আজকে জায়গাটা কেমন অন্যরকম লাগছে। নতুন শহরে এখানেই তোমার সাথে আমার প্রথম দেখা। কোন এক বৈশাখ কি জৈষ্ঠ্যে হবে তোমার বাবার সাথে এসেছিলে। সাথে অবশ্য তোমার ফ্রেন্ডও ছিল। ঠিক এখানটায় বসে ছিলাম রাস্তার ওপার টায় তুমি ছিলে। সেদিন বিকেলটাও এরকম ঘন কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে ছিল। এরপর আরও কত বিকেল এখানে তোমার সাথে কাটিয়েছি। সে সব আজ......
> কি রে কি এতো ভাবছিস? এভাবে বসে বসে ভিজছিস কেন?
> তুই কখন এলি? বৃষ্টিতে ভিজিস না ঠান্ডা লাগবে।
> ঘুম থেকে উঠে দেখি তুই নাই, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বুঝলাম যে তুই এখানে আর আমারও ভালো লাগছেনা তাই ভাবলাম তোর পাগলামিতে সামিল হই।
> ভালো করেছিস। ঠান্ডা লাগছে থাম চা নিয়ে আসি।
এভাবে বৃষ্টিতে ভিজে চা খাওয়ার মাঝে অদ্ভুত এক আনন্দ আছে। চা সহজে শেষ হয়না তবে ঠান্ডা হয়ে যায় আর স্বাদটাও অন্যরকম। আজকে আবার পাশে একটা কুকুর জুটেছে। অনেকক্ষণ ধরে চারপাশে ঘুর ঘুর করছে। বোধ হয় আমাদের বসে থাকাটা পছন্দ করছে না। পছন্দ না করলেই বা কি? সব তো আমাদের মানুষের হাতেই। আমরা চাইলেই ওদের যেকোন যাইগা থেকে বিতাড়িত করতে পারি কিন্তু ওরা তো সেটা পারে না। কুকুরটা জিভ বের করে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার একটু অস্বস্তি হচ্ছিলো। রক্তিম বললো ক্ষুধা লাগছে বোধ হয়। ৫ টাকার একটা রুটি কিনে কুকুরটাকে দিতেই ওটা নিয়ে দিলো দৌড়। কৌতুহল বশত আমরাও পিছু নিলাম। যেয়ে দেখি একটা বন্ধ দোকানের সামনে অন্য একটা কুকুরের সাথে রুটিটা ভাগ করে খাচ্ছে। আহা কি বন্ধুত্ব। এবার আবার ২ জন হাটতে শুরু করলাম। চারপাশটা শুনশান। কোন লোকজন দেখতে পাচ্ছিনা। বৃষ্টির বেগটাও ক্রমশ বেড়ে চলেছে। কেন জানি আজ অনেকদিন পর মনের মধ্যে শান্তি বয়ে যাচ্ছে। এই রাস্তা গুলো আমার অনেক চেনা। একসময় এখানে অবাধ চলাচল ছিল। বহুদিন অবশ্য আসা হয়নি এদিকে।
রক্তিমঃ কোথায় যাচ্ছিস?
আমিঃ সুখ খুজতে। যাবি??
রক্তিমঃ সুখের সন্ধান তো আমিও করি। চল যাই।
আমরা হেটে চলেছি। কিছুদূর এসে থামালাম। সামনে কিছু কুড়ে ঘর।
রক্তিমঃ এখানে থামলি যে?
আমিঃ এখানেই তো সুখ।
ঘরগুলোর একটা থেকে একজন ডাকলো, " ওখানে ওভাবে ভিজছো কেন? ভিতরে আসো।"
আমরা ভিতরে গেলাম। তিনজন মানুষ থাকার জন্য যতটা ছোট ঘর বানানো সম্ভব এটা বোধহয় তার চেয়েও ছোট। ঘরে এখন আমরা ৫ জন। চাচা, চাচি, তাদের ছোট্ট মেয়ে শিলা, রক্তিম আর আমি। ছোট ঘর হলেও আমরা বেশ আরামে বসলাম। শিলা একটা গামছা নিয়ে এসে তার ছোট হাত দুটো দিয়ে আমার মাথা মুছে দিয়ে বলছিল, " এভাবে ভিজছো কেন? জ্বর আসবেনি তো।" গামছা টা রক্তিমকে দিয়ে বলল," মুছে নাও"
চাচি একটা বাটিতে কিছু মুড়ি এনে বলল, " ঘরে আপাতত এই আছে। খাও। তুমি তো আর আসোই না। আমাদের কথা আর মনে পড়েনা বাপ?"
আমিঃ পড়ে চাচি। কিন্তু আর আসা হয়না। আজ হঠাৎ শিলার কথা মনে হলো তাই আসলাম। কোন দোকান খোলা পাইনি রে অনেকক্ষণ থেকে বৃষ্টিতো তাই তোর জন্য চকলেট ও আনতে পারিনি।
শিলাঃ চকলেট লাগবেনা। তুমি এসেছো এতেই অনেক খুশি হয়েছি ভাইয়া। আপুকে নিয়ে এসো একদিন। আপু তো অনেকদিন হলো আসেনি।
আমিঃ হুম। তুই পড়াশোনা করছিস তো?
শিলাঃ হ্যাঁ। ভাইয়া করি তো।
এদিকে রক্তিম খাওয়ায় ব্যস্ত। যেখানে পাই সেখানেই খাই অবস্থা। খেতে খেতে হঠাৎ বলে উঠল, চাচা আপনি কি করেন?
চাচাঃ যখন যে কাজ পাই তাই করি বাপ। দিন আনি দিন খাই সংসার বেশ ভালোই চলে।
শিলাঃ আব্বা সারাদিন কাম কইরা চাল আর তরকারি আনে, মা রান্ধে। আমরা সবাই মিলে একসাথে খাই। জানো তো আমার মায়ের রান্ধা খুব সুন্দর। তোমাদের একদিন খাওয়াবে মা।
চাচিঃ হ্যাঁ বাবা। একদিন আমাদের এখানে দাওয়াত নাও।
আমিঃ জ্বি চাচি একদিন খাবো আপনার রান্না।
বৃষ্টি থেমে গেল। আকাশটা পরিষ্কার। আমরা বেড়িয়ে পড়লাম, " থাক রে শিলা। ভালো করে পড়াশোনা করিস।"
শিলাঃ সাবধানে যাও ভাইয়া। তুমি আর বৃষ্টিতে ভিজো না।
আমরা এগিয়ে চলেছি। ওদের সাথে কাটানো এই সময় টুকু অসাধারণ ছিল। কোন কিছু নিয়ে আক্ষেপ হচ্ছিল না আর। আগে প্রায়ই তোমার সাথে এখানে আসা হতো। এই বাচ্চা গুলোর সাথে সময় কাটাতে তোমার ভালো লাগত। অনেকদিন এমুখো হয়নি। আজ এদের সাথে হয়ে মনে এক প্রশান্তি কাজ করছে।
রক্তিমঃ তোর কাজ গুলো পাগলামি বলি ঠিকি। কিন্তু আজ তোর সাথে না আসলে বুঝতাম না যে এই পাগলামির মাঝেও কতটা শান্তি আছে। কংক্রিটের এই শহর থেকে ওই বুনের কুড়েঘরে যে এতটা সুখে মানুষ বাস করে সেটা তুই না থাকলে জানা হতো না। আজ না হয় সুখের খোজেই যাই, চল।
আমরা হেটে চলেছি। আর গুন গুনিয়ে গাচ্ছি রবী ঠাকুরের সেই গান, " তুমি সুখও যদি নাহি পাও, যাও সুখের-ও সন্ধানে যাও"
এস. এম নাহিদ হাসান
Comments (0)