'তোর বড়ভাই আরেকটা বিয়া করছে রে কুমুদ। নতুন বউটা খুব সুন্দর, একেবারে চান্দের লাহান। আর আমারে দেখ কত জঘন্য লাগে দেখতে! তোর ভাই মনে হয় আমারে তালাক দিবো।'
আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম বড়ভাবির দিকে। কী বলছেন তিনি এসব!
আমার বিস্মিত চাউনি দেখে বড়ভাবি গা দুলিয়ে হেসে উঠে বললেন, 'কিরে এমনে চাইয়া আছোস কেন? বিশ্বাস হয়না? কাইল বেইন্নাই নতুন বউরে ঘরে উঠাইবো, তখন দেখিস।'
আমার বিস্ময়ের ঘোর এখনো কাটেনি। বড়ভাবি মিথ্যে বলার মানুষ নন, তবে কী ভাই সত্যিই আরেকটা বিয়ে করেছেন? অসম্ভব! নিজেকে কোনোমতে সামলে জিজ্ঞেস করলাম, 'ভাই আরেকটা বিয়ে কেন করবে? আপনি কীভাবে জানলেন এসব?'
ভাবি আবারো হেসে উঠলেন, অদ্ভুত হাসি।
'আমার স্বামী আর আমি জানমু না? কীসব যে বলিস তুই! গত ৯ টা বছর যাবৎ তোর ভইয়ের লগে সংসার করতেছি কুমুদ। মানুষটারে যে আমি খুব ভালো কইরা চিনি।'
হঠাৎ ভাবির মুখটা মলিন হয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, 'মাইয়াটা তার অপিসে কাজ করে। গত ৪ বছর তার লগে তোর ভাইয়ের প্রেম ছিলো রে কুমুদ। প্রথম প্রথম আমি কিছুই বুঝি নাই। তোর ভাই প্রত্যেকটা দিন দেরি কইরা বাড়ি ফিরত, সব সময় ওই মোবাইল নিয়া পইড়া থাকতো। আমি কিছু জিগাইলেই আমার গায়ে হাত তুলতো।'
আমি যেন স্তব্ধ হয়ে গেছি। ভাই ভাবির গায়ে হাত তুলতো? কই ভাবিতো কোনোদিন কিছু জানায়নি!
অবিশ্বাস্য কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, 'ভাই আপনার গায়ে হাত তুলতো? এতদিন তো কিছুই বলেননি।'
ভাবি মুচকি হাসলেন, হাসিতে ব্যাথার ছাপ স্পষ্ট।
'বারান্দায় খাঁচায় ওই টিয়াপাখিটারে দেখো, তোমার ভাই খুব শখ কইরা আনছিলো। কিন্তু পোষ মানাইতে পারে নাই। দেখো, পাখিটা মুক্ত হওনের জন্যে কেমন ছটফট করতাছে। আমাগো মতন মাইয়াগো বিয়ার পর ঠিক এই দশা হয়। সংসারের চাইর দেয়ালের মধ্যে পুরা জীবন পার কইরা দেই আমরা, অত্যাচার-অপমান সব সহ্য কইরা। একটু নিশ্বাস নিয়া বাঁচার জন্যে ওই পাখিটার মতোই ছটফট করি কিন্তু পারি না। কেবল মরণেই আমরা হাঁপ ছাইড়া বাঁচি।'
একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন, 'জানো কুমুদ, বিয়ার পর প্রথম যখন এই বাড়ি আসলাম, তখন অনেক স্বপ্ন দেখছিলাম স্বামী, সন্তান নিয়া সুখের সংসারের। কিন্তু পোড়া কপাল আমার, স্বপ্ন স্বপ্নই রইয়া গেল। হে যখন প্রথম প্রথম আমারে মারতো সহ্য করতে না পাইরা একদিন মায়ের কাছে নালিশ দিছিলাম।
মা তখন কইলো, "পুরুষ মানুষ হইলো বাঘের জাত। একটু-আধটু রাগ না করলে হে কীসের পুরুষ? স্বামীর অধিকার আছে বউরে শাসন করার। মাইয়াগো ধৈর্য্য ধইরা থাকতে হয়। ধৈর্য্য ধইরা থাকবা, জামাইর কথা মতো চলবা। তাইলে দেখবা সব ঠিক হইয়া যাইবো। আর খবরদার এ নিয়া কাউরে কিছু বলবানা, জামাইর সম্মান আছে না?"
সেদিনই বুঝছিলাম, বিয়ার পর মাইয়ারা পর হইয়া যায়। আর আমারতো কোনোখানে যাওয়ার জায়গা নাই। গেরামের মাইয়া আমি, লেখাপড়াও করি নাই তেমন, তাই মায়ের কথামতো এতগুলা বছর ধৈর্য্য ধইরাই রইছি। সব কিছু মুখ বুইজা সহ্য কইরা শেষে...'
ভাবি নিঃশব্দে কাঁদছেন। আমার আর সহ্য হচ্ছে না। হঠাৎ ভাবিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম। একটা মানুষ আমাদের জন্য এতকিছু করার পরেও দিনের পর দিন এত কষ্ট-যন্ত্রণা-লাঞ্ছনা করে যাচ্ছে, বিনিময়ে কী পেল সে?
ভাবি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। বিড়বিড় করে বললেন, 'তুমি বড় হইছো কুমুদ, আইজ নইলে কাইল পরের ঘরে যাবা। খবরদার আমার মতো পরিণতি যেন না হয় তোমার। ভালো কইরা পড়ালেখা কইরা নিজের পায়ে খাঁড়াও,পায়ের নিচের মাটিখান শক্ত করো। আমার মতো ভুল কইরো না। এহন নিজের ঘরে যাও দেখি। আমি ঘরটা গুছাই, বেইন্না নতুন মানুষ আইবো তো।'
আমি নিষ্পলক তাকিয়ে আছি বড়ভাবির দিকে। এত কিছুর পরেও কীভাবে স্বাভাবিক থাকার এমন নিঁখুত অভিনয় করছেন তিনি? প্রতিটা নারীকেই কী এমন অভিনয় করে বাঁচতে হয়?
পশ্চিম আকাশে লালিমা ছড়িয়ে সূর্য তার গন্তব্যে পাড়ি দিয়েছে। নিস্তব্ধ প্রকৃতি ধীরে ধীরে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, একমনে ভাবির কবরের দিকে তাকিয়ে। আজ চারদিন হলো ভাবি মারা গেছেন। আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন তিনি, সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করে ধীরে ধীরে মৃত্যুর পথে অগ্রসর হওয়া আত্মহনন নয় কি?
ভাবির শেষ ইচ্ছে ছিল বাড়ির উঠানের এক কোণে যেন তাকে কবর দেওয়া হয়। ভাইয়া তার ইচ্ছা পূরণ করেছেন। ভীষণ হাসি পাচ্ছে আমার। আমার সুপুরুষ ভাই তার কর্তব্য পালনে বিন্দুমাত্র পিছপা হননি। কিছুক্ষণ পর টিয়াটাকে খাঁচা থেকে বের করে আকাশে উড়িয়ে দিলাম, ভাবিতো মুক্তি পেয়েছেন, এবার তবে পাখিটাও মুক্তি পাক।
লেখনীতে কুহেলী কানন
(ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দিবেন দয়া করে)
Comments (0)